ভগবান বুদ্ধের প্রকারভেদ

  

ভগবান বুদ্ধের প্রকারভেদ

পবিত্র ত্রিপিটক শাস্ত্রের বর্ণনামতে বুদ্ধ তিন প্রকার। যথা :

১. সম্মাসম্মুদ্ধ বা সম্যকসম্বুদ্ধ।

২. পচ্চেক বুদ্ধ বা প্রত্যেকবুদ্ধ।

৩. সাবকবুদ্ধ বা শ্রাবকবুদ্ধ।

 সম্যক সম্বুদ্ধ :

যিনি কোনো গুরুর সাহায্য ছাড়া স্বীয় আদর্শ ও কর্মের দ্বারা নিরলস প্রচেষ্টায় বুদ্ধত্ব লাভ করেন, তাঁকে সম্যক সম্বুদ্ধ বলে । তিনি সর্বোত্তম জ্ঞানের অধিকারী। সম্যক সম্বুদ্ধ সকল জীবের কল্যাণে তাঁর দুঃখমুক্তির পথ ও নির্বাণলাভের উপায় প্রচার করেন।

প্রত্যেক বুদ্ধ

সম্যক সম্বুদ্ধের অনুপস্থিতিতে যিনি নিজের প্রচেষ্টায় চতুরার্য সত্য জ্ঞাত হয়ে তৃষ্ণা ক্ষয় করে আর্হত্ব ফল লাভ করে, তাঁকে পচ্চেক বুদ্ধ বা প্রত্যেক বুদ্ধ বলে। । তাঁরা সম্যক সম্বুদ্ধের দেশিত সাধনপ্রণালী অনুশীলন করে সর্বতৃষ্ণা ক্ষয় করেন। প্রত্যেকবুদ্ধগণের সাধনালব্ধ জ্ঞান কেবল নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। অৰ্হত্ব ফললাভী এবং নির্বাণগামী এরূপ অসংখ্য প্রত্যেকবুদ্ধ পৃথিবীতে উৎপন্ন হয়েছেন এবং ভবিষ্যতেও হবেন। এজন্য জগৎ অহৎ বুদ্ধশূন্য নয়।

শ্রাবকবুদ্ধ

শ্রাবকবুদ্ধ হলো সম্যকসম্বুদ্ধের অনুশাসন অনুশীলনে পারঙ্গম পুণ্যপুরুষ।একজন সম্যসম্বুদ্ধের অনেক শিষ্য থাকেন।এই শিষ্যদেরও অনেক শিষ্য থাকেন।এসব শিষ্য ও প্রশিষ্যগণ সম্যকসম্বুদ্ধের নির্দেশিত পথ অনুসরণ করে মুক্তিসাধনায় রত থাকেন।এঁদের মধ্যে অনেকে অর্হত্ব ফল লাভ করেন। তাঁরা আর জন্মগ্রহণ করে দুঃখ ভোগ করবেন না।তাঁরা নির্বাণগামী।এরূপ বিমুক্ত পুরুষকে বলা হয় শ্রাবকবুদ্ধ।

বুদ্ধের অনেক শিষ্য শ্রাবক বুদ্ধ ছিলেন।তাঁদের মধ্যে অগ্রশাবক সারিপুত্র ও মৌদগল্যায়ন, মহাকশ্যপ, বিনয়ধর উপালি, ধর্মভাণ্ডারিক আনন্দ, লাভীশ্রেষ্ঠ সীবলী প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া বুদ্ধের সময় অনেক শ্রাবক বুদ্ধ ছিলেন। তাঁরা জীবজগতের কল্যাণে নিজেদের নিয়োজিত রাখেন এবং অন্যদের নির্বাণলাভে সহায়তা করেন। 

বুদ্ধ -ধর্ম-সংঘ গুন বন্দনা পালি & বাংলা অনুবাদ

 বুদ্ধ -ধর্ম-সংঘ গুন বন্দনা পালি & বাংলা

নয়গুণ সম্পন্ন বুদ্ধ বন্দনা:
পালি:: ইতিপি সো ভগবা অরহং, সম্মাসম্বুদ্ধো, বিজ্জাচরণ সম্পন্নো, সুগতো, লোকবিদু, অনুত্তরো পুরিসদম্ম সারথী, সত্থাদেবমনুসসানং, বুদ্ধো, ভগবাতি।
বাংলা অনুবাদ:: তিনি সেই ভগবান অরহত, সম্যক সম্বুদ্ধ, বিদ্যা ও আচরণ সম্পন্ন, সুপথে গমনকারী, সমস্ত জড় অজড় জগৎ জ্ঞাতা, সর্বশ্রেষ্ঠ দেব-ব্রহ্মা-নর-যক্ষ-তির্যক প্রভৃতির অদম্য পুরুষ দমনকারী সারথি, দেব-মনুষ্যদের শিক্ষক, বুদ্ধ, ভগবান।
ছয়গুণ সম্পন্ন ধম্ম বন্দনা:
পালি:: স্বাকখাতো ভগবতো ধম্মো, সন্দিটঠিকো, অকালিকো, এহিপসসিকো, ওপনাযিকো, পচ্চত্তং বেদিতব্বো বিঞ্ঞূহী’তি।
বাংলা অনুবাদ: ভগবান কর্তৃক ধর্ম উত্তমরূপ ব্যাখ্যাত, স্বয়ং দর্শনীয়, ফল প্রদানে কালাকাল বিরহিত, ‘এসে দেখ’ এই রূপ বলবার যোগ্য, নির্বাণ প্রাপক এবং বিজ্ঞজন কর্তৃক প্রত্যক্ষভাবে জ্ঞাতব্য।
নয়গুণ সম্পন্ন সংঘ বন্দনা:
পালি:: সুপটিপন্নো ভগবতো সাবকসংঘো, উজুটিপন্নো ভগবতো সাবকসংঘো, ঞায়পটিপন্নো ভগবতো সাবকসংঘো, সমীচিপটিপন্নো ভগবতো সাবকসংঘো যদিদং চত্তারি পুরিসযুগানি অটঠ পুরিসপুগগলা এস ভগবতো সাবকসংঘো, আহুণেয্যো, পাহুণেয্যো, দকখিণেয্যো অঞ্জলিকরণীয্যো, অনুত্তরং পুঞ্ঞকখেত্তং লোকসসা’তি ।
বাংলা অনুবাদ:: ভগবানের শ্রাবক সংঘ সুপথে প্রতিপন্ন, ঋজু আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ প্রতিপন্ন, ন্যায় প্রতিপন্ন, সমীচীন, যথার্থ, উত্তম প্রতিপন্ন ভগবানের শ্রাবক সংঘ যুগ্ম হিসাবে চার যুগল এবং পুদগল হিসাবে অষ্ট আর্য পুদ্গলই চার প্রত্যয় দান-আহুতি লাভের যোগ্য, খাদ্য ভোজ্য দ্বারা পূজার যোগ্য, অঞ্জলিপুটে নতশিরে বন্দনা করবার যোগ্য ও সমস্ত দেব নর সর্বশ্রেষ্ঠ পুণ্যক্ষেত্র।

ত্রিরত্নের গুণ - উ ওয়ান্নিতা পঞ্ঞা ভিক্ষু

 

Top of Form

Bottom of Form

ত্রিরত্নের গুণ

উ ওয়ান্নিতা পঞ্ঞা ভিক্ষু

সূচিপত্র
প্রকৃত ধর্ম কি?
বুদ্ধ তিন প্রকার আছে
চার প্রকার চৈত্য বা জাদী
ত্রিশরণে স্রোতাপত্তি মার্গ লাভ
একজন উপাসক কিছুক্ষণ ত্রিশরণ ধারণ করার সুফল
দল্হতো নামে একজন মেয়ের ত্রিশরণ ধারণে বৌদ্ধ ধর্মের উত্থান
ত্রিশরণ বিশ্বাসে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ
ত্রিশরণ সত্য ক্রিয়ায় বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ
সরণগমন মহাথের ভন্তের জীবনি
ত্রিশরণে মন্ত্রবিদ্যা নষ্ট হয়
এক ব্যবসায়ী  ত্রিশরণ স্মরণ করার সুফল
ত্রিশরণ ধারণে সম্যক দেবতারা রক্ষা করে
গরুর গাড়িতে একজন তুলা ব্যবসায়ীর কাহিনী
বুদ্ধানুস্মৃতি ভাবনার মাধ্যমে অরহত্ব মার্গ ফল লাভ
বৌদ্ধধর্ম বিশ্বাসে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ
বৌদ্ধ ধর্মের সাথে অন্যধর্মের পূণ্যের পার্থক্য   
একটি ছোট্ট কুটিরে বাঁশ দানের পূণ্য ফলে নরক থেকে উদ্ধার
একজন শ্রদ্ধাবান উপাসকের হৃদয়ে বুদ্ধ স্থাপন
বৌদ্ধ ধর্মের সার

প্রকৃত ধর্ম কি?
 প্রকৃত ধর্ম বলতে ভগবান বুদ্ধ কি দর্শন করেছেন? প্রকৃতিতে যা  কিছু ঘটছে অবিরাম প্রক্রিয়ায়, তার অন্তর্নিহিত সত্যকেই তিনি দর্শন করেছেন। চক্রবালের সকল সত্ত্বগণ পরমার্থ দৃষ্টিতে
রূপ-নাম ছাড়া আর কিছুই নয়। এই পৃথিবীর যাবতীয় বস্তুই রূপ এর আওতাধীন। সকল সত্ত্ব, সকল বস্তুই ধ্বংস হচ্ছে অর্থাৎ ক্ষয়শীল বা অনিত্য। লৌকিক দৃষ্টিতে মনে হয় এ জগত সুখময়, কিন্তু প্রকৃত অর্থে  দুঃখ ছাড়া কিছুই নেই। এই পরিবর্তিত ধর্মই দুঃখময়, যেখানে আমি আমার এ কথাগুলো মূল্যহীন হয়ে সেখানেই অনাত্ম দর্শন হয়। ত্রি-লক্ষণ জ্ঞান দ্বারা ১৬ প্রকার বিদর্শন জ্ঞান পরিপূর্ণতার মধ্য দিয়ে নির্বাণ ধর্মকে দর্শন করা হয়। এই নির্বাণ ধর্মই হচ্ছে লোকত্তর ধর্ম। বুদ্ধ যে ধর্ম দর্শন করেছেন তাকে লোকত্তর ধর্ম বা নির্বাণ ধর্ম বা প্রকৃতি ধর্মও বলা যায়। এই নির্বাণ প্রদায়ী ধর্ম লাভ করেও আমরা যদি বুদ্ধের ধর্মকে  জানতে না পারি,তাহলে ধর্মান্তরিত হওয়ার ইচ্ছা জাগতেই পারে। যে ব্যক্তি ধর্মান্তরিত হয়েছে,সে অজ্ঞানী মূখের্র ন্যায়,নির্বাণ ধর্ম হতে বঞ্চিত হয়। এতে মৃত্যুর পর অপায় নামক দুঃখে  পতিত হয়। বৌদ্ধ ধর্ম ছাড়া অন্য যে মতবাদ বা  ধর্ম বিদ্যমান তা লৌকিক,যা শুধুমাত্র পৃথিবীর মানুষেরা আচরণ করে থাকে। কিন্তু বৌদ্ধ ধর্ম লোকত্তর ধর্ম হওয়াতে শুধু মানুষ নয়,দেবতা,ব্রহ্মা হতে শুরু করে দশ হাজার চক্রবালের অগণিত সত্ত্বগণ বুদ্ধের ধর্ম আচরণ করে।

বুদ্ধ তিন প্রকার আছে
 সম্মাসম্বুদ্ধ বা সম্যকসম্বুদ্ধ,পচ্চেকবুদ্ধ বা প্রত্যেকবুদ্ধ,সাবকবুদ্ধ বা শ্রাবকবুদ্ধ।
  সম্মাসম্বুদ্ধ বা সম্যকসম্বুদ্ধ-সম্যক সম্বুদ্ধ তিন প্রকার আছে। পঞ্ঞাধিক সম্মাসম্বুদ্ধ বা প্রজ্ঞাধিক সম্যকসম্বুদ্ধ,সদ্ধাধিক সম্মাসম্বুদ্ধ বা শ্রদ্ধাধিক সম্যকসম্বুদ্ধ,বীরিযাধিক সম্মাসম্বুদ্ধ বা বীয্যাধিক সম্যকসম্বুদ্ধ।
 (ক) প্রজ্ঞাধিক সম্যকসম্বুদ্ধ হচ্ছেন-যিনি জন্ম-জন্মান্তর প্রজ্ঞাকে প্রাধান্য দিয়ে বোধিসত্ত্ব পারমী পূরণ করেন তিনি প্রজ্ঞাধিক সম্যকসম্বুদ্ধ। উনারা স্বয়ং ধ্যান-সাধনা করে সর্বজ্ঞতা জ্ঞান প্রাপ্ত হন এবং সকল প্রাণীর মুক্তির জন্য সদ্ধর্ম দেশনা করেন। প্রজ্ঞাধিক বোধিসত্ত্বগণকে সম্যক সম্বুদ্ধ হতে আশীর্বাদ প্রাপ্ত হবার পর চার অসংখ্যেয় এক লক্ষ কল্প যাবৎ পারমী পরিপূর্ণ করতে হয়। যেদিন থেকে বর প্রাপ্ত হন সেদিন হতে বোধিসত্ত্ব নামে পরিচিতি লাভ করেন। আর প্রত্যেক বোধিসত্ত্বগণকে আশীর্বাদ প্রাপ্ত না হবার পূর্বে মানসিকভাবে সাত অসংখ্যেয়,বাচনিকভাবে নয় অসংখ্যেয় মোট ষোল অসংখ্যেয় পারমী পূরণ করে আসতে হয়।যখন মানসিকভাবে এবং বাচনিকভাবে পরিপূর্ণতা লাভ করেন,তখন এক বুদ্ধের আবির্ভাবের
মাধ্যমে সম্যক সম্বুদ্ধ হবার জন্য মনষ্কামনা পরিপূর্ণ করেন। বর্তমান গৌতম বুদ্ধ পারমী পূরণকালে মানসিকভাবে ১,২৫,০০০জন সম্যক সম্বুদ্ধ আর বাচনিকভাবে ৩,৮৭,০০০জন সম্যক সম্বুদ্ধ পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়ে পরিনির্বাপিত হয়েছেন। আশীর্বাদ প্রাপ্ত হবার পর ২৭জন সম্যক সম্বুদ্ধ মোট হিসাব করলে ৫,১২,০২৭জন সম্যক সম্বুদ্ধ। সেজন্য বুদ্ধ বলেছেন-জগতের মধ্যে বুদ্ধ উৎপন্ন হওয়া দুর্লভ।   
(খ) শ্রদ্ধাধিক সম্যকসম্বুদ্ধ হচ্ছেন- যিনি জন্ম-জন্মান্তর শ্রদ্ধাকে প্রাধান্য দিয়ে বোধিসত্ত্ব পারমী পূরণ করেন তিনি শ্রদ্ধাধিক সম্যকসম্বুদ্ধ। শ্রদ্ধাধিক বোধিসত্ত্বগণকে সম্যক সম্বুদ্ধের নিকট আশীর্বাদ প্রাপ্ত হবার পর থেকে আট অসংখ্যেয়  এক লক্ষ কল্প যাবৎ পারমী পরিপূর্ণ করতে হয়।
 (গ) বীয্যাধিক সম্যকসম্বুদ্ধ হচ্ছেন-যিনি জন্ম-জন্মান্তর বীয্যকে প্রাধান্য দিয়ে বোধিসত্ত্ব পারমী পূরণ করেন তিনি বীয্যাধিক সম্যক সম্বুদ্ধ। বীয্যাধিক বোধিসত্ত্বগণকে সম্যক সম্বুদ্ধের নিকট আশীর্বাদ প্রাপ্ত হবার পর থেকে ষোল অসংখ্যেয় এক লক্ষ কল্প যাবৎ পারমী পরিপূর্ণ করতে হয়।
 পচ্চেকবুদ্ধ বা প্রত্যেকবুদ্ধ- যিনি জন্ম-জন্মান্তর দুই অসংখ্যেয় পারমী পূরণ করে তিনি  প্রত্যেক বুদ্ধ হন। তাঁরা স্বয়ং চতুরার্য সত্য দর্শন করে অরহত্ব মার্গজ্ঞান-ফলজ্ঞান লাভ করেন কিন্তু সদ্ধর্ম দেশনা করতে সক্ষম হন না।
 সাবকবুদ্ধ বা শ্রাবকবুদ্ধ- তিন প্রকার শ্রাবক বুদ্ধ। অ¹সাবক বা অগ্রশ্রাবক, মহাসাবক বা মহাশ্রাবক, পকতিসাবক বা সাধারণশ্রাবক।
 অগ্রশ্রাবক :-দুই প্রকার উপাধি প্রাপ্ত অগ্রশ্রাবক। বুদ্ধের ডান হস্ত প্রজ্ঞার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হন। বুদ্ধের বামহস্ত ঋদ্ধির মধ্যে প্রধান হন। যেমন এ বুদ্ধের শাসনামলে সারিপুত্র স্থবির এবং মোদগল্লায়ন স্থবির। উনারা নির্দিষ্টভাবে এক অসংখ্যেয়  একলক্ষ কল্প যাবৎ পারমী পূরণ করে অরহত্ব মার্গফল লাভ করেন।
 মহাশ্রাবক :-৮০জন মহাশ্রাবকের মধ্যে দু
জন অগ্রশ্রাবক সহ ৩৯ জন ছিলেন উপাধি প্রাপ্ত মহাশ্রাবক। যেমন-বুদ্ধের প্রধান সেবক আনন্দ স্থবির, দিব্য চক্ষুর মধ্যে অনুরূদ্ধ স্থবির, অগ্রলাভীর মধ্যে সীবলী স্থবির, বিনয়ধারীর মধ্যে উপালী স্থবির, ধুতাঙ্গধারীর মধ্যে মহাকস্সপ স্থবির, প্রভৃতি উপাধি প্রাপ্ত মহাশ্রাবক ছিলেন পারমীবান আর্যব্যক্তি। উনারাও নির্দিষ্টভাবে একলক্ষ কল্প যাবৎ পারমী পূরণ করে অরহত্ব মার্গফলে উপনীত হন।
সাধারণ শ্রাবক :-তাঁরা কোন বুদ্ধ হতে বর প্রাপ্ত নন বিধায় নির্দিষ্টভাবে পারমী পূরণ করতেহয়না। যে কোন একটি পুণ্যের হেতুতে একজন্মে, দুইজন্মে, তিনজন্মে, শতজন্মে, সহস্রজন্মে, লক্ষজন্মের প্রভৃতি যে কোন জন্মের মধ্যে অরহৎ হতে পারেন। অনির্দিষ্ট জন্মে অনির্দিষ্ট কালে সৎ গুরুর সান্নিধ্যে বিদর্শন ভাবনা করে অরহত্ব মার্গফল লাভ করতে সক্ষম হন। 

      শ্রাবকদের মধ্যেও চার প্রকার অরহৎ আছে।পটিসম্ভিদাপত্ত-অরহন্ত, ছলভিঞ্ঞ-অরহন্ত, তেবিজ্জ-অরহন্ত, সুক্খবিপস্সক-অরহন্ত।
 পটিসম্ভিদাপত্ত অরহন্ত - প্রতিসম্ভিদাপ্রাপ্ত  অরহৎ  চারভাগে  বিভক্ত  করা  হয়েছে।  (ক) অত্থ পটিসম্ভিদা- কুশল ও অকুশলের ফলধর্মকে সঠিকভাবে জানার জ্ঞান, পালি ব্যাকরণের অনুবাদ সঠিকভাবে জানার জ্ঞান, বিভিন্ন প্রকার দুঃখকে সঠিকভাবে জানার জ্ঞান,সংস্কার দুঃখ নিরোধে নির্বাণ ধর্মকে জানার জ্ঞান।                              (খ) ধম্ম পটিসম্ভিদা-কারণধর্মকে সঠিকভাবে জানার জ্ঞান,পালি ব্যাকরণকে সঠিকভাবে জানার জ্ঞান, দুঃখ উৎপন্ন হবার কারণ ধর্মকে সঠিকভাবে  জানার  জ্ঞান, দুঃখ নিরোধে নির্বাণ ধর্মকে মার্গ দ্বারা জানার জ্ঞান।                                 (গ) নিরুত্তি পটিসম্ভিদা-কথাবলার জন্য যে পালি ব্যাকরণ প্রয়োজন হয় সে ব্যাকরণের সঠিক এবং ভুল পার্থক্য ভাগ করে জানার জ্ঞান।                                   (ঘ) পটিভাণ পটিসম্ভিদা- অত্থ পটিসম্ভিদা, ধম্ম পটিসম্ভিদা, নিরুত্তি পটিসম্ভিদা এ তিন প্রকার ধর্মকে বিস্তারিত ভাবে জানার জ্ঞান।
ছলভিঞ্ঞ অরহন্ত- ছয় প্রকার অভিজ্ঞান প্রাপ্ত অরহৎ। ছয় প্রকার অভিজ্ঞান হচ্ছে দিব্যচক্ষু জ্ঞান, দিব্যকর্ণ জ্ঞান, পরচিত্ত বিজনন জ্ঞান, জাতিস্মর জ্ঞান, ঋদ্ধিময় জ্ঞান। এ পাঁচ প্রকার অভিজ্ঞান লৌকিক জ্ঞান। বাকী চতুর আস্রব ক্ষয় জ্ঞান হচ্ছে লোকত্তর প্রজ্ঞার অন্তর্গত।
তেবিজ্জ অরহন্ত - তিন প্রকার বিদ্যা সম্পন্ন অরহৎ। তিন প্রকার বিদ্যা হচ্ছে দিব্যচক্ষু জ্ঞান, পরচিত্ত বিজনন জ্ঞান, আস্রব ক্ষয় জ্ঞান।
সূক্খ বিপস্সক অরহন্ত- সূক্ষè বিদর্শন লাভী অরহৎ যাঁরা, তাঁরা শুধুমাত্র ক্ষণিক সমাধির মাধ্যমে রূপ-নাম ধর্মকে ত্রিলক্ষণ জ্ঞান দিয়ে বিদর্শন ভাবনা করে অরহত্ব মার্গফলে উপনীত হন। উনারা অভিজ্ঞান ছাড়াই অরহত্ব মার্গ ফল লাভ করেন।

ক্স অর্থকথা গুরুরা বলেছেন বুদ্ধ শাসন স্থিতি থাকবে ৫ (পাঁচ) হাজার বৎসর
১) প্রতিসম্ভিদা প্রাপ্ত অরহৎগণের শাসন ১ (এক) হাজার বৎসর
২) ষড়াভিজ্ঞ প্রাপ্ত অরহৎগণের শাসন ১ (এক) হাজার বৎসর
৩)  ত্রিবিদ্যা সম্পন্ন অরহৎগণের শাসন ১ (এক) হাজার বৎসর
৪) সূক্ষ্ম জ্ঞানসম্পন্ন অরহৎগণের শাসন ১ (এক) হাজার বৎসর
৫) স্রোতাপন্ন, সকৃদাগামী, অনাগামী প্রাপ্তগণের শাসন ১ (এক) হাজার বৎসর।
বুদ্ধের পরিনির্বাণের এক হাজার বৎসর পর্যন্ত প্রতিসম্ভিদাপ্রাপ্ত অরহৎগণ থাকেন। দুই হাজার বৎসর পর্যন্ত ষড়াভিজ্ঞ অরহৎগণের শাসন। তিন হাজার বৎসর পর্যন্ত ত্রিবিদ্যা অরহৎগণের শাসন। সুতরাং স্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছে যে বর্তমানে বুদ্ধ শাসন আড়াই হাজারেরও অধিক বৎসর পার হয়ে তিন হাজার বৎসরের শাসন চলছে। অর্থাৎ ত্রিবিদ্যা সম্পন্ন অরহৎগণ বর্তমানে আছেন। তবে বুদ্ধ এটাও বলেছেন যে,যতদিন পর্যন্ত আমার এ ধর্ম আচরিত হবে ততদিন পর্যন্ত অরহৎ শূণ্য থাকবেনা। ষড়াভিজ্ঞ অরহৎ কাকে বলে? সমথযান ও সূক্ষ্ম বিদর্শনযান দুই প্রকার আছে। সমথযান বলতে ধ্যানবল লাভ করতে পারে এমন একটি কর্মস্থান ভাবনা দ্বারা রূপাবচর ধ্যান ও অরূপবচর ধ্যান লাভ করে পঞ্চ অভিজ্ঞান পরিপূর্ণ করতে হয়। পাঁচ প্রকার অভিজ্ঞান প্রাপ্ত হবার পর পঞ্চ স্কন্ধের প্রতি ত্রিলক্ষণ জ্ঞান দিয়ে বিদর্শন ভাবনা করে অরহত্ব মার্গফল লাভীকে ষড়াভিজ্ঞ অরহৎ বলে। বর্তমানে মায়ানদেশে ফা অ ধ্যান কেন্দ্রে সমথযান শিক্ষা দেওয়া হয়। সূক্ষ্ম বিদর্শনযান বলতে ক্ষণিক সমাধির মাধ্যমে রূপ বা নামের প্রতি ত্রিলক্ষণ জ্ঞান দিয়ে বিদর্শন ভাবনা করে অরহত্ব মার্গফল লাভীকে সূক্ষ্ম বিদর্শনযান অরহৎ বলে। সূক্ষ্ম বিদর্শনযান অরহৎবৃন্দ কোন প্রকার অভিজ্ঞান প্রাপ্ত হন না। যাঁরা ধ্যানবল এবং বিদর্শন জ্ঞান,মার্গজ্ঞান-ফলজ্ঞান লাভ করতে চায় তাঁরা একজন সঠিক কর্মস্থান গুরুর সান্নিধ্যে ভাবনায় রত থাকতে হবে। পরিযত্তি শিক্ষা ও কর্মস্থান গুরু ছাড়া ধ্যানবল এবং বিদর্শন জ্ঞান লাভ করে মার্গজ্ঞান-ফলজ্ঞান লাভ করা সম্ভব নয়। 

চার প্রকার চৈত্য বা জাদী
ধাতু চেতী-ধাতু চৈত্য,ধম্ম চেতী-ধর্ম চৈত্য,উদ্দিস্স চেতী-উদ্দেশ্য চৈত্য ও পরিভোগ চেতী- পরিভোগ চৈত্য।
ধাতু চৈত্য
 বুদ্ধ পরিনির্বানের পর দন্ত ধাতু,রক্ত ধাতু,চুলধাতু,মাংস ধাতু,অস্থি ধাতু প্রভৃতি শরীর থেকে উৎপন্ন হওয়া ধাতু স্থাপনে নির্মিত  চৈত্যকে  ধাতু চৈত্য বলে। বর্তমানে পৃথিবীতে শ্রীলংকায় দন্তধাতু, চীনদেশে দন্তধাতু,মায়ানমার দেশে চুলধাতু সহ বিভিন্ন শরীর ধাতু রয়েছে। বাংলাদেশের  বান্দরবানে পরম শ্রদ্ধেয় শ্রীমৎ উ পঞ্ঞা জোত মহাথের মহোদয় মহাসুখ প্রার্থনা পূরক বুদ্ধ ধাতু চৈত্য,বুদ্ধ ধাতু চৈত্যের নংদগ্রী চৈত্য, রাম চৈত্য,রাম নংদগ্রী চৈত্য,ক্যমলং চৈত্য স্থাপন করে বুদ্ধ শাসনের উন্নতিতে যে অবদান রেখে গেছেন,তা শত শতাব্দী ধরে অক্ষয় হয়ে থাকবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও শরীর ধাতু রয়েছে যা দেব-মনুষ্যগণ পুজা করছেন। পৃথিবী ছাড়াও তাবতিংস স্বর্গে চুলধাতু এবং দন্তধাতু,নাগদেশে দন্তধাতু রয়েছে। এছাড়া  বিভিন্ন চক্রবালে ত্রিরতেœর প্রতি শ্রদ্ধা সম্পন্ন দেব-ব্রহ্মাগণ বুদ্ধের ধাতু চৈত্যকে পূজা করছেন।

        বুদ্ধের পরিনির্বাণের পর অধিষ্ঠান করা শরীরধাতু আনয়ন করতে রাজা অজাতশত্র
সাতবৎসর সাতমাস সাতদিন যাবৎ মহাসমারহে ধাতু পূজা করেছিলেন। বুদ্ধের ঐ শরীর ধাতুকে পূজা করে বহু দেব-মনুষ্য-ব্রহ্মা সুগতি প্রাপ্ত হয়েছিলেন। আর মিথ্যাদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তিরা বুদ্ধের শরীর ধাতুকে,অস্থি ধাতুকে পূজা করে কি লাভ,এরূপ  ধারণায়  মানসিক-বাচনিক পাপ সঞ্চয় করার ফলে ছিয়াশি হাজার মনুষ্য প্রেত লোকে জন্ম গ্রহণ করেছিল।
         রাজা অজাতশত্র
কর্তৃক বুদ্ধের শরীর ধাতু পূজার সময়ে, এক মধ্যম শ্রেণীর শ্রেষ্ঠী পরিবারের স্ত্রী,মেয়ে,পুত্রবধূ বুদ্ধের শরীর ধাতু পূজার উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন। তখন শ্রেষ্ঠী অস্থি পূজা করে কি পুণ্য হবে  বলাতে তাঁর যে বাচনিক পাপ হয়েছিল সে পাপের ফলে ধাতু বিবণ্ণক নামক প্রেত হয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আর পরিবারের স্ত্রী,মেয়ে,পুত্রবধূ ধাতু পূজার পুণ্যের ফলে স্বর্গে গমন করেছিলেন।
         ঐ একই সময়ে, দীনহীন এক গরীব মেয়ে শ্রদ্ধা-ভক্তি সহকারে চারটি স্বর্ণ বর্ণের লতাজাতীয় ফুল নিয়ে ধাতু  পুজা দিতে যাচ্ছিল। গমনের সময় পথি মধ্যে এক গাভীনির শিং এর আঘাতে মেয়েটির মৃত্যু হয়েছিল। ধাতু পূজা দিতে সক্ষম না হয়েও  ধাতু  পূজার উদ্দেশ্যে অকৃত্রিম শ্রদ্ধা-ভক্তিতে গমন করছিল বলে মৃত্যুর পর  তাবতিংস স্বর্গে স্বর্ণময় রূপলাবণ্যে সুন্দরী দেবী হয়ে জন্ম গ্রহণ করেছিল।
         
মহে্দ্র অরহৎ ভন্তে শ্রীলংকাতে ধর্মপ্রচার করতে গিয়েছিলেন। উনার সদ্ধর্ম দেশনা শ্রবণ করে বহু মানুষ মার্গফল লাভ করেছিলেন। নির্বাণ ধর্ম লাভ করেছেন সত্য কিন্তু বুদ্ধ শাসনের ভিত্তি তখনো প্রতিষ্ঠা হয়নি। ভারত থেকে বুদ্ধের শরীর ধাতু আনয়ন করে যখন ধাতু চৈত্য নির্মাণ করেছিলেন,তখনই বুদ্ধ শাসনের মূল স্তম্ভ প্রতিষ্ঠা হয়।
         
অরহংভন্তে বুদ্ধের ধর্ম প্রচার প্রসারত্বে মায়ানমার দেশে আগমন কালে শ্রীলংকা হতে বুদ্ধের ধাতু সাথে এনেছিলেন। উক্ত ধাতু প্রতিস্থাপন করে  নির্মিত ধাতু চৈত্য এখনো প্রমাণ স্বরূপ সাক্ষী দিচ্ছে।
 মায়ানমারে একটি গ্রামে একজন বার্মিস  ও আরেক জন মুসলিম রাখাল ছেলে ছিল। তারা দুই বন্ধু  জঙ্গলে গরু চড়াতে গিয়েছিল। জঙ্গলে গিয়ে দেখল এক ছোট্ট জাদী। তা দেখে  সে বার্মিস রাখাল ছেলের প্রবল শ্রদ্ধা উৎপন্ন হওয়ায় জঙ্গলের ফুল খোঁজ করে জাদীতে পূজা  করে করজোড়ে বন্দনা করল। তারপর মুসলিম রাখাল ছেলেটিকে বলল,তুমিতো কিছুই দান করনি,বন্দনাও করনি। মুসলিম ছেলেটির কিভাবে শ্রদ্ধা উৎপন্ন হবে বা কেন বন্দনা করবে? তবুও ছেলেটি অবচেতন মনে ভাবছে আমার দেওয়ার  মতো কিছু না থাকলেও সাথে থাকা লাঠিটি জাদীতে তুলে রাখি। অশ্রদ্ধাভাবে তুলে রাখলেও এতে তার পুণ্য সঞ্চয় হয়েছিল। কিন্তু প্রমাণ কি? সেই মুসলিম রাখাল ছেলেটি হঠাৎ একদিন জ্বরে আক্রান্ত হয়ে অজ্ঞান অবস্থায় যম রাজার নিকট বিচারের জন্য উপস্থিত হয়। যম রাজা বললেন, তুমিতো মিথ্যা দৃষ্টি পরিবারের লোক। তোমার পুণ্য সঞ্চয় করার কোন সুযোগ নেই। তাই তোমার বিচার করতে হবেনা বলে একে নরকে নিয়ে যাও আদেশ দিলেন যমরাজা। তখন নরক পালেরা তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে নরকের আগুনে ফেলে দিল। কিন্তু  সেই মুহুর্তে একটি লাঠি এসে তাকে আটকে রাখল। দ্বিতীয় ও তৃতীয় বারও একই ঘটনা ঘটল। তখন নরক পালেরা যম রাজার কাছে এসে বলল, তাকে ফেলতে গেলে একটি লাঠি এসে আটকে রাখে। একথা শুনে যম রাজা সেই মুসলিম ছেলেটিকে পুনরায় জিজ্ঞেস করল, তুমি মনুষ্য  কূলে কি পুণ্য কর্ম করেছিলে ? একটু স্মরণ করে দেখ। সে স্মরণ করে বললো আমি জাদীতে একটি লাঠি দান করেছিলাম। তখন যমরাজা বলল,তুমি তাহলে মনুষ্য কূলে গিয়ে আবার পুণ্য সঞ্চয় করে এসো। তখন নরক পালেরা তাকে পুণরায় পৃথিবীতে মনুষ্য কূলে পাঠিয়ে দিল। মারা যাওয়ার পর আবার মনুষ্য জীবন প্রাপ্ত হওযায় বৌদ্ধ ধর্মের আশ্চর্য গুণ বুঝতে পেরে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে প্রভূত পুণ্য সঞ্চয় করতে থাকে।

ধর্ম চৈত্য
 লোকত্তর ধর্ম আট প্রকার, নির্বাণ ধর্ম এক প্রকার ও ত্রিপিটকশাস্ত্র এ দশ প্রকার ধর্মকে ধর্ম-চৈত্য বলা হয়।

উদ্দেশ্য চৈত্য
 নয়টি গুণসহ অনন্ত গুণের অধিকারী বুদ্ধকে উদ্দেশ্য করে শ্রদ্ধা-ভক্তি সহকারে বুদ্ধ মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে যে চৈত্য নির্মাণ করা হয় তাকে উদ্দেশ্য চৈত্য হিসেবে পূজা করা হয়।
       তথাগত ভগবান বুদ্ধ শ্রাবস্তীর জেতবন বিহারে অবস্থান করছিলেন। মুক্তিকামী সত্ত্বগণের কল্যাণার্থে বুদ্ধপ্রমুখ ভিক্ষু সংঘ দেশচারী পরিভ্রমণে প্রত্যাগমন কালে, কোশলরাজসহ মন্ত্রীবর্গ একত্রিত হয়ে বুদ্ধের নিকট আগমন করে করজোড়ে বন্দনা জ্ঞাপন করার পর নিবেদন করলেন যে, ছয় প্রকার লাভ সৎকারে পরিপূর্ণ, নয় প্রকার গুণ, দশ প্রকার বলে পরিপূর্ণ ভগবান বুদ্ধ,আপনি দেশচারী পরিভ্রমণ কালে আমরা আপনাকে দান দেওয়ার বা পূজা করার কোন সুযোগ পাই না। আপনি উপস্থিত থাকলেতো দান দিতে পারি। তাই আপনার পরিবর্তে শ্রদ্ধার সহিত বুদ্ধের প্রতি মূর্তি তৈরী করে পূজা করলে কেমন হয় ভগবান বুদ্ধ? ভগবান বুদ্ধ প্রত্যুত্তরে বললেন- সাধু মহারাজ সাধু সাধু। উপযুক্ত প্রস্তাব করেছ। অতীতেও বুদ্ধের অনুসারীরা বুদ্ধের প্রতি মূর্তি তৈরী করে পূজা করেছিল,অনাগতেও সেভাবে পূজা করবে বলে বুদ্ধ প্রজ্ঞপ্তি করলেন। কোশলরাজ ধর্মশ্রবণ করার পর মন্ত্রী পরিষদসহ রাজ প্রাসাদে ফিরে আসলেন। আগমনের পর সুগন্ধযুক্ত চন্দনবৃক্ষ সংগ্রহ করলেন এবং মন্ডপ প্রস্তুত করে পবিত্র কর্ম সম্পাদন করাকালে,
দেবরাজ ইন্দ্র বসে  থাকতে পারলেন না। মাতলি- বিষ্ণু দেবপুত্রকে ডাক। ভাই বিষ্ণু, পৃথিবীতে মনুষ্য লোকে কোশল রাজার নিকট গিয়ে বুদ্ধের প্রতিমূর্তি তৈরী করে আস। দেবরাজ ইন্দ্রের আদেশে,বিষ্ণু দেবপুত্র পৃথিবীতে মিস্ত্রি রূপ ধারণ করে, রাজার প্রস্তুতকৃত মন্ডপে আগমন করে বললেন,আমি বুদ্ধের প্রতিমূর্তি তৈরী করতে পারি। তাঁর কথায় কোশল রাজ সম্মতি প্রদান করলে,অল্প কিছু দিনের মধ্যে তিনি বুদ্ধমূর্তি তৈরী করতে সক্ষম হলেন। বুদ্ধের প্রতিবিম্ব দর্শন করে কোশল রাজ অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে সামনে-পেছনে দেখতে লাগলেন। মনুষ্য রূপী মিস্ত্রিকে কোশল রাজ জিজ্ঞেস করলেন,দাম কত দিতে হবে? না মহারাজ আমি কোন টাকা নেব না,শুধুমাত্র পুণ্যই নিতে চাই। শ্রদ্ধায় চেতনায় বুদ্ধমূর্তি তৈরীর পুণ্যফল সাধুবাদ প্রদানের মাধ্যমে বিতরণ করার পর তাবতিংস স্বর্গে প্রত্যাগমন করলেন। কোশল রাজ জেতবন বিহারে আগমন করে বুদ্ধের পদমূলে বন্দনা জ্ঞাপন করার পর বললেন-ভগবান বুদ্ধ আপনার প্রতিমূর্তি তৈরীর কাজ সমাপ্ত হয়েছে। আপনিসহ ভিক্ষু সংঘকে প্রতিবিম্ব দর্শন করার জন্য প্রার্থনা করছি। রাজ প্রাসাদে ভগবান বুদ্ধ আগমন করে তৈরীকৃত প্রতিমূর্তি বুদ্ধের অলৌকিক ঋদ্ধি প্রভাবে পালঙ্ক হতে উত্থিত হবার ভাব ভঙ্গিমা দেখে বুদ্ধ বললেন, আবুসো তিট্ঠতু। আবুসো এ স্থানে বুদ্ধ স্বরূপ বসবাস কর,এ বলে প্রজ্ঞপ্তি করলেন। কোশল রাজ আনন্দিত হয়ে বুদ্ধপ্রমুখ ভিক্ষু সংঘকে আহারাদি দান করার পর জিজ্ঞেস করলেন- ভগবান বুদ্ধ,আপনার উদ্দেশ্যে তৈরীকৃত বুদ্ধের প্রতিমূর্তিকে পূজা করে পূজারী কিরূপ পুণ্যের সুফল পেতে পারে?
 ভগবান বুদ্ধ,প্রত্যুত্তরে বললেন-
বুদ্ধবিম্বং করাযেতে, ন গচ্ছন্তি দু¹তিযং।
                                    জাযন্তি মজ্ঝিমে দেসে, বুদ্ধবিম্বস্সিদং ফলং

অনুবাদ- মহারাজ যে মনুষ্যগণ বুদ্ধ প্রতিমূর্তি তৈরী করার পর, শ্রদ্ধা-ভক্তি চিত্তে পূজা করে, সে মনুষ্যগণ দুর্গতিতে গমন করে না এবং মধ্যম দেশে অর্থাৎ বুদ্ধের মাতৃ ভূমিতে জন্মগ্রহণ করে থাকেন। ইহা বুদ্ধের প্রতিবিম্বকে পূজার সুফল।
                                       আযুবা বলবা ধীরো,বিসারদো বহুস্সুতো।
                                       তিক্খ পঞ্ঞোপেমনিযো,বুদ্ধবিম্বসদিসং ফলং।
অনুবাদ-দীর্ঘাযু লাভ করে,বলবান হয়,ধীর সম্পন্ন প্রজ্ঞাবান হয়,বিশারদ বহুশ্রোতময় জ্ঞানের অধিকারী হয়,তীক্ষè প্রজ্ঞা সম্পন্ন হয় এবং সকলের নিকট মৈত্রী ভালবাসা লাভ করে। ইহা বুদ্ধ প্রতিবিম্বকে পূজার সুফল ।
                                       ভবাভবে সংসরন্তো,অমিতং ভোগং লব্ভন্তি।
                                       অমিত ভোগং লভিত্বান,বরং নিব্বান পাপুণি।
অনুবাদ- জন্ম-জন্মান্তর সংসার চত্রে
অতুলনীয় ভোগ-সম্পত্তি লাভ করে। লৌকিক সম্পত্তি পরিপূর্ণভাবে প্রাপ্ত হবার পর পরম সুখ নির্বাণ ধর্মে উপনীত হয়। তখন থেকে কোশল রাজ সহ পরম্পরায় ধার্মিক রাজাগণ,প্রজাগণ,মনুষ্যগণ বুদ্ধের পরিবর্তে বুদ্ধের প্রতিমূর্তিকে উদ্দেশ্য জাদী বা চৈত্য হিসেবে পূজা করে আসছে।
        মায়ানমারে এক গ্রামে একজন শীলবান ভিক্ষু হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে স্বর্গে গমন করেন। স্বর্গে গিয়ে দর্শন করেন একটি সুন্দর বিমান। ভন্তে বিমানের রক্ষাকারী দেবীদেরকে জিজ্ঞেস করলেন,এ বিমানটি কার। দেবীরা বলল,এ বিমান এখনো মালিক বিহীন। তবে পৃথিবীতে মনুষ্য লোকে আছেন। আপনি পৃথিবীতে গিয়ে বলবেন,তাঁর জন্য বিমান তৈরী করা হয়েছে। আমরা তাঁর জন্য অপেক্ষা করছি। ভন্তে দেবীদের থেকে ঐ বিমান মালিকের  ঠিকানা নিলেন। অমুক গ্রামে অমুক নামে এক শ্রদ্ধাবতী ধার্মিক উপাসিকা আছে। সেই ভিক্ষুর যখন জ্ঞান ফিরে আসে তখন ঐ শ্রদ্ধাবতী উপাসিকার খোঁজ করতে লাগলেন। খোঁজ করতে করতে তাঁর বাড়ি পৌঁছলেন। পৌঁছে দেখলেন, ছোট্ট একটি ঘরে বিধবা একজন গরীব উপাসিকা। তাঁর একটি মেয়ে আছে। মা আর মেয়ের সংসার জীবন কোন মতে চলে। গরীব হলে কি হবে খুবই শ্রদ্ধাবতী । ভন্তে উপাসিকার নিকট গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার নাম অমুক কি? উপাসিকা বললেন,হ্যাঁ ভন্তে। ভন্তে জিজ্ঞেস করলেন,আচ্ছা উপাসিকা আপনি কি কি পুণ্য কর্ম করেন? উপাসিকা বললেন, যেহেতু আমি গরীব, দান দেয়ার সামর্থ্য নাই। তবে আমি ছোট কাল হতে বুদ্ধের উদ্দেশ্যে ভাত-ছোয়াইং,তরকারী-ছোয়াইং,পানীয় জল,ফুল-মালা দান করতাম। তখন আমি জীবন্ত বুদ্ধকে দান করছি, এই চেতনা রেখে পাশে বসে পাখা করতাম। এভাবে শ্রদ্ধা-ভক্তি চিত্তে ছোয়াইং দান করে আসছি বহু বৎসর যাবৎ। এখনো প্রতিনিয়ত ছোয়াইং দান করি। বুদ্ধকে পূজা করা ছাড়া আমার আর কোন পুণ্য সঞ্চয় নেই। তখন ভন্তে উপাসিকাকে বললেন, তাঁর জন্য স্বর্গে বিমান উৎপন্ন হয়েছে। এ কথা শুনে উপাসিকা আনন্দিত হয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে শ্রদ্ধা-চেতনাকে আরো বৃদ্ধি করে অপ্রমেয় পুণ্য সঞ্চয় করতে লাগলেন।

পরিভোগ চৈত্য
বুদ্ধের ব্যবহৃত জিনিসপত্র, অষ্টপরিস্কার ও বোধিবৃক্ষকে পরিভোগ চৈত্য বলে।
     গৌতম বুদ্ধের সময়ে অরহত্ব মার্গফল প্রাপ্ত ভিক্ষু-শ্রমণেরা অতীতে বোধিবৃক্ষ পুজা করে যে সুফল পেয়েছেন তা নিুে বর্ণিত হল।
     পুলিন পূজক থের নামে একজন অরহৎ ভিক্ষু ছিলেন। তিনি অতীত জন্মে বিপস্সী বুদ্ধের সময়ে বোধিবৃক্ষের মূলে পুরাতন বালিগুলো অপসারন করে নতুন সূবর্ণ বালি দ্বারা ভরাট করেছিলেন। সেই পুণ্যের ফলে দেবলোকে যোজন প্রমাণ বিমান লাভ করেন। অন্তিম জন্মে গৌতম বুদ্ধের সময় মানব জন্ম লাভ করে, বুদ্ধ শাসনে প্রব্রজিত হয়ে ভিক্ষু হয়েছিলেন। ধ্যান সাধনা করে অচিরেই পুলিন পূজক থের নামে অরহত্ব মার্গফল লাভ করেন।
      কন্দোদকিয় থের নামে একজন অরহৎ ভিক্ষু ছিলেন। তিনি অতীত জন্মে পদুমুত্তর বুদ্ধের সময়ে বোধিবৃক্ষের মূলে সুগন্ধি জাতীয় পানি দিয়ে পূজা করেন। সেই পুণ্যের প্রভাবে দেবলোকে জন্ম গ্রহণ করেন। অন্তিম জন্মে গৌতম বুদ্ধের সময় কন্দোদকিয় থের নামে অরহত্ব মার্গফল লাভ করেন।
      দীপক থের নামে একজন অরহৎ ভিক্ষু ছিলেন। তিনি অতীত জন্মে পদুমুত্তর বুদ্ধের সময়ে বোধিবৃক্ষকে তৈল প্রদ্বীপ দ্বারা পূজা করেছিলেন। সেই পুণ্যের প্রভাবে দেবলোকে জন্মগ্রহণ করেন। অন্তিম জন্মে গৌতম বুদ্ধের সময়ে দীপক থের নামে অরহত্ব মার্গফল প্রাপ্ত হন।
      অসন বোধিয় নামে একজন অরহৎ শ্রমণ ছিলেন। তিনি অতীত জন্মে তিস্স বুদ্ধের সময়ে বোধিবৃক্ষ রোপন করার পর ৭ বৎসর যাবৎ পরিচর্যা করেছিলেন। সেই পুণ্যের প্রভাবে মৃত্যূর পর দেব লোকে জন্ম গহণ করেন। অন্তিম জন্মে গৌতম বুদ্ধের সময় ৭ বৎসর বয়সে শ্রমণ অবস্থায় অরহত্ব মার্গফলে প্রতিষ্ঠিত হন।
     বোধি সিঞ্চক থের নামে একজন অরহৎ ভিক্ষু ছিলেন। তিনি অতীত জন্মে বিপস্সী বুদ্ধের সময়ে বোধিবৃক্ষে পরিস্কার জল সিঞ্চনে পূজা করে ভিক্ষু জীবন গ্রহণ করেছিলেন। সেই পুণ্যের প্রভাবে ৯১ কল্প পর্যন্ত অপায় মুক্ত হয়ে পরবর্তী মানব জন্মে ৩০কল্প রাজা হয়ে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। অন্তিম জন্মে গৌতম বুদ্ধের সময় বোধি সিঞ্চক থের নামে অরহত্ব মার্গফল লাভ করেন।
     সিবন্দক থের নামে একজন অরহৎ ভিক্ষু ছিলেন। তিনি অতীত জন্মে বিপস্সী বুদ্ধের পরিনির্বাণের পর প্রগাঢ় শ্রদ্ধা বিশ্বাসে বুদ্ধের শরীর ধাতুর সাথে বোধিবৃক্ষ দান করেন। সেই পুণ্যের প্রভাবে অন্তিম জন্মে গৌতম বুদ্ধের সময়ে চার প্রকার প্রতিসম্ভিদা, ছয় প্রকার অভিজ্ঞান প্রাপ্ত হয়ে সিবন্দক থের নামে অরহত্ব মার্গফল লাভ করেন।
     বোধিয় থের নামে একজন অরহৎ ভিক্ষু ছিলেন। তিনি অতীত জন্মে অনোমদস্সী বুদ্ধের সময়ে ঢোল বাজানো একজন বাদক ছিলেন। তিনি শ্রদ্ধা চিত্তে প্রতিদিন বোধিবৃক্ষকে সকালে একবার রাতে একবার বন্দনা করে পূজা করতেন। সেই পুণ্যের প্রভাবে ১৮০০কল্প পর্যন্ত অপায় মুক্ত হয়ে সুগতি প্রাপ্ত হন। অন্তিম জন্মে গৌতম বুদ্ধের সময়ে বোধিয় থের নামে অরহত্ব মার্গফল লাভ করেন।
      উত্তলী পুপ্পিয় থের নামে এক অরহৎ ভিক্ষু অতীত জন্মে কস্সপ বুদ্ধের সময়ে বোধিবৃক্ষকে ফুল দিয়ে পূজা করার পুণ্যের ফলে শেষ জন্মে গৌতম বুদ্ধের সময় উত্তলী পুপ্পিয় থের নামে অরহত্ব মার্গফল লাভ করেন।
     বেদিকারক থের নামে এক অরহৎ ভিক্ষু অতীত জন্মে পদুমুত্তর বুদ্ধের সময়ে বোধিবৃক্ষের চতুর্পার্শ্বে ঘেরা দিয়ে পুণ্য সঞ্চয় করেন। সেই পুণ্যের ফলে জন্ম-জন্মান্তর অন্তরায় মুক্ত হয়ে এক কল্প পর্যন্ত অপায়মুক্ত হয়ে সুগতি প্রাপ্ত হন। অন্তিম জন্মে গৌতম বুদ্ধের সময় বেদিকারক থের নামে অরহত্ব মার্গফল প্রাপ্ত হন।
      বোধিঘ মহাথের নামে এক অরহৎ ভিক্ষুর অতীত জন্মে সিদ্ধাত্থ বুদ্ধের সময়ে বোধিবৃক্ষ দর্শন করে শ্রদ্ধা উৎপন্ন হয়েছিল। তাই বোধিবৃক্ষের মূলে বিশ্রামের ঘর তৈরী করে দিয়েছিলেন। সেই পুণ্যের ফলে জন্ম-জন্মান্তর দেবরাজ ইন্দ্র, চক্রবাল রাজা হয়েছিলেন। অন্তিম জন্মে গৌতম বুদ্ধের সময় বোধিঘ মহাথের নামে অরহত্ব মার্গফল প্রাপ্ত হন।
 জগতিদাদ নামে এক অরহৎ ভিক্ষু, অতীত জন্মে ধম্মদস্সী বুদ্ধের সময়ে বোধিবৃক্ষের মূলে ইট দিয়ে পাকা করে দিয়েছিলেন। সেই পুণ্যের ফলে পঞ্চশত্র
মুক্ত হয়ে মনুষ্যজন্ম  ও দেবজন্ম লাভ করেন। শেষ জন্মে গৌতম বুদ্ধের সময় জগতিদাদ নামে অরহত্ব মার্গফল প্রাপ্ত হন।
 সীহসন পিলিয় থের নামে এক অরহৎ ভিক্ষু, অতীত জন্মে তিস্স বুদ্ধের সময়ে বোধিবৃক্ষে পাখা দ্বারা বাতাস করেছিলেন। সেই পুণ্যের ফলে শেষজন্মে গৌতম বুদ্ধের সময়ে সীহসন পিলিয় থের নামে অরহত্ব মার্গফল লাভ করেন।
       তিনুক্কচরিয় থের নামে এক অরহৎ ভিক্ষু, পদুমুত্তর বুদ্ধের সময়ে বোধিবৃক্ষ মূলে মোমবাতি ও তৈল প্রদ্বীপ দ্বারা পূজা করেন। সেই পুণ্যের প্রভাবে এক লক্ষ কল্প পর্যন্ত অপায় মুক্ত হয়ে সুগতি প্রাপ্ত হন। শেষ জন্মে গৌতম বুদ্ধের সময় তিনুক্কচরিয় থের নামে অরহত্ব মার্গফল প্রাপ্ত হয়েছিলেন।
 বৃক্ষ এবং দেবতাকে পূজা নয়। যিনি বৃক্ষমূলে উপবেশনে ধ্যান সাধনায় চতুরার্য সত্য দর্শন করে সম্যকসম্বুদ্ধ জ্ঞান লাভ করেছিলেন,সেই বোধিজ্ঞানকে উদ্দেশ্য করে,বৌদ্ধরা পরিভোগ চৈত্য হিসেবে পূজা করে থাকেন।

ত্রিশরণে স্রোতাপত্তি মার্গ লাভ
ভগবান বুদ্ধের সময়ে একজন ত্রিশরণধারী শ্রদ্ধাবান উপাসকের কথা বলা হয়েছে
বুদ্ধের সময়ে তাঁর  শাক্য বংশের আত্মীয় এক উপাসক ত্রিশরণ পালন করত বলে তাকেত্রিশরণ উপাসকডাকা হত। এই উপাসক এমনভাবে নেশা পান করত যে, আজীবন নেশা পান করেই আয়ু ক্ষয়ে মৃত্যু হল। তার মৃত্যুর পর সে স্বর্গের দেবপুত্র হয়েছে বলে তথাগত ভগবান বুদ্ধ ঘোষণা করলেন। তখন শাক্য বংশীয়রা এই কথাটি শুনে  ভগবান বুদ্ধের বদনাম করতে লাগলেন। তাদের ভাষ্য,তারা তো প্রতিনিয়ত পঞ্চশীল রক্ষা করেন,আর সে তো আজীবন নেশা পানেই মত্ত ছিল। দান,শীল,ভাবনাময় পুণ্য কর্ম কিছুই করেনি। সেই ব্যক্তি কিভাবে মরণের পর স্বর্গে যেতে পারে? তাই একথা কেউ বিশ্বাস করতে চাইলনা। তখন মহানাম  ভগবান বুদ্ধকে বললেন,শাক্যবংশরা আপনার বদনাম করছে। তাঁরা বলছে ঐ ত্রিশরণ উপাসক আজীবন নেশা পান করে মৃত্যুর পর কিভাবে স্বর্গে যেতে পারে একথা কেউ  বিশ্বাস করতে পারছে না

 প্রত্যুত্তরে বুদ্ধ বললেন,তাহলে শ্রবণ কর মহানাম। সেই উপাসক ত্রিশরণ পালন করে আসছে বহুদিন যাবত,তাই তার নেশাপান জনিত অকুশল কর্মের বিপাক বলবৎ না হয়ে,কুশল কর্ম শক্তিশালী হওয়াতে স্বর্গে গমন করেছে। তখন বুদ্ধ নিুোক্ত গাথাটি ভাষণ করলেন।
বহুম্হি কুসলেহি আয়ূহিতে বলবকম্মং
              দুব্বল কম্মস্স বিপাকং পটিবাহিত্বা
              অত্তনো বিপাকস্স ওকাসং করোতি।

অনুবাদ- বলবৎ শক্তিশালী কুশল কর্ম,দুর্বল অকুশল কর্মকে ধ্বংস করে, কুশল কর্মের বিপাক প্রদান করে থাকে। তার দুইটি গুণ ছিল,ঐ ত্রিশরণ উপাসককে যদি বলা হত, তুমি বুদ্ধকে বুদ্ধ নয়,ধর্মকে ধর্ম নয়,সংঘকে সংঘ নয় বল,না বললে তোমাকে হত্যা করা হবে। উত্তরে সে বলত,প্রয়োজনে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করব,এরপরও আমি ত্রিশরণ ত্যাগ করব না।
 ভগবান বুদ্ধ আরো বললেন,তার আরেকটি গুণ রয়েছে। তাকে যদি প্রচুর ধন-সম্পত্তিও  দেওয়া হয়,তবুও সে ত্রিশরণ ত্যাগ করবে না। 

দ্বেসা ভিক্খবে আসা দুপ্পজহা, কতমা দ্বে,
                        লাভা সা চ জীবিতাসা চ, ইমানি খো
                        ভিক্খবে দ্বে আসা দুপ্পজহা।

অনুবাদ- লাভ সৎকার ত্যাগ করা অতীব দুরহ এবং জীবনের মায়া  ত্যাগ করা আরও কঠিন ব্যাপার।
এ দু
টি গুণের মধ্যে যে কোন একটির অধিকারী যিনি, তিনি ধ্যান সাধনা না করেও  মার্গফলে উপনীত হন। সে ত্রিশরণ উপাসকের এ দুই গুণাবলীর কারণে মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে মার্গফলে প্রতিষ্ঠিত হয়ে স্বর্গে উৎপন্ন হন।
অর্থকথা গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে যে, বুদ্ধকে একবার মাত্র প্রসন্ন চিত্তে ভালবাসলে-
   
দসবলে একো সদ্ধা একং পেমং উপ্পজ্জতি,
     তায় সদ্ধায় তেন পেমেন হত্থে গহেত্বা স¹
     ঠপিত্বা বিয় হোন্ডি, নিয়তগতিকা কির এতে
     পোরণকথেরা পন এবরুপং পু¹লং চূলসোতাপন্নোতি বদন্তি

অনুবাদ- দশবলে পরিপূর্ণ সম্যক সম্বুদ্ধের প্রতি চিত্তে একবার শ্রদ্ধা ভালবাসা উৎপন্ন হলে,সেই শ্রদ্ধা ও ভালবাসার কারণে স্বর্গে পদার্পনের পথ প্রশস্ত হয়। অর্থকথা গুরুরা আরও বলেছেন, সেই ব্যক্তি চূল স্রোতাপন্ন হয়ে থাকেন। শুধুমাত্র বুদ্ধকে নয়, ভিক্ষু সংঘকেও শ্রদ্ধা-ভক্তি দিয়ে পূজা করলে বহুফল লাভ হয়।
ময়িচিত্তংপসাদেত্বা, ভিক্খুসংঘে অনুত্তরে,
      কপ্পসত সহস্সানি, দু¹তিং সো ন গচ্ছতি

অনুুবাদ- অনুত্তর পুণ্যক্ষেত্র ভিক্ষু সংঘকে একবার দর্শনে যদি চিত্তের মধ্যে শ্রদ্ধা উৎপন্ন হয় তাহলে সেই ব্যক্তি একলক্ষ কল্প পর্যন্ত অপায় থেকে মুক্ত থাকে।
স্বর্গে ত্রিশরণধারী দেবতা ও অন্যান্য দেবতাদের তুলনা মূলক দশ প্রকার পার্থক্য-
 অন্যান্য দেবতাদের তুলনায় ত্রিশরণধারী দেবতা আয়ু, বর্ণ, সুখ, যশ-খ্যাতি, পরিষদ-বর্গ শাসন-ক্ষমতা, রুপ,শব্দ,গন্ধ, রস,স্পর্শ লাভ করে।                                                                                                         
শুধুমাত্র ১০ প্রকার পার্থক্য আছে তা নয়। গ্রন্থে আরও উল্লেখ আছে -
    এতং খো পন সরণং খেমং, এতং সরণ মুত্তমং।
    এতং সরণ মাগম্ম, সব্বদুক্খা পমুচ্চতি।
অনুবাদ- এই ত্রিশরণ গ্রহণের ফলে সকল প্রকার আপদ-বিপদ থেকে রক্ষা প্রাপ্ত হয়। সর্ব প্রকার দুঃখ থেকে মুক্ত হয়ে নির্বাণ ধর্মকে পর্যন্ত দর্শন করতে সক্ষম হয়।

একজন উপাসক এর  কিছুক্ষণ ত্রিশরণ ধারণ করার সুফল
       কিছুক্ষণ ত্রিশরণ ধারণকারী
ধম্মিল নামে একজন উপাসক ছিলেন। সে ব্যক্তি ৫০ বছর যাবত মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিলেন। একদিন উপাসকের শরীরে এক কঠিন রোগ দেখা দিল। যন্ত্রনায় তিনি বিছানা থেকে উঠতে পযর্ন্ত সক্ষম ছিল না। আজীবন প্রাণী হত্যা করেছিল বলে পাপকর্ম গুরুতর হয়েছিল। সে পাপের ফলে নরকের বিভিন্ন নিমিত্ত যথা: নরকের অগ্নিপাত্র, নরকপাল, নরকের কুকুর, শকুন প্রভৃতি ভয়ংকর  দৃশ্য আলম্বন হচ্ছিল। তখন ধম্মিলের  মনে ভয় জাগ্রত হল, সে চিৎকার শুরু করল। সেই মূহুর্তে একজন ভিক্ষু উপস্থিত হয়স্ত্রী স্বামীকে বলল,একজন ভিক্ষু আগমন করেছেন। স্বামী স্ত্রীকে বলল,আমার জীবনে ৫০ বছর যাবৎ এই ভিক্ষুকে আমি দেখিনি, উনিও আমাকে দেখেননি।  তাঁর প্রতি আমার কোন কৃতজ্ঞতা নেই। এদিকে স্ত্রী সে কথাটি না বলে আরেকটি কথা বলল,ভন্তে ক্ষমা করবেন,স্বামী খুব অসুস্থ। বিছানা থেকে তাঁর পক্ষে উঠে আসা সম্ভব নয়। তখন ভিক্ষু চিন্তা করলেন উপাসককে উদ্ধার করতে হবে। তিনি অসুস্থ উপাসকের সামনে গিয়ে বসলেন। ভন্তে জিজ্ঞেস করলেন, উপাসক শীল পালন করতে পারবেন কি? উপাসক বলল, পারবো ভন্তে। যেভাবে শীল প্রদান করা হয়, ভন্তে সেভাবে শীল দিতে শুরু করলেনত্রিশরণ দেবার শেষ মুহুর্তে উপাসক দেহ ত্যাগ করলেন। কিন্তু পঞ্চশীল নিতে সক্ষম হলেন না। মরণের পর পর চতুর্মহারাজিক স্বর্গে দেবপুত্র হয়ে জন্ম গ্রহণ করলেন। দেবপুত্র হয়ে জন্ম নেবার কারণটা তিনি দিব্য চক্ষু দিয়ে দর্শন করে জানলেন একজন ভন্তের উপকারের কথা। আমি শুধুমাত্র ত্রিশরণ গ্রহণের ফলে চতুর্মহারাজিক স্বর্গে দেবপুত্র হয়েছি। ভন্তের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরুপ তাঁর নিকট আগমন করলেন। শ্রদ্ধাচিত্তে করজোড়ে বন্দনা জ্ঞাপন করে, একপাশে স্থিত থাকলেন। ভন্তে দেবপুত্রকে জিজ্ঞেস করলেন,তুমি কে? দেবপুত্র বলল ভন্তে আপনি আমাকে অসুস্থ অবস্থায় ত্রিশরণ এবং পঞ্চশীল দিয়েছিলেন,সেই ধম্মিল উপাসক। তুমি এখন কোন স্বর্গে অবস্থান করছ? দেবপুত্র বলল, ভন্তে আমি এখন চতুর্মহারাজিক স্বর্গে অবস্থান করছি। তবে  আমি যদি পঞ্চশীল নিতে পারতাম তাহলে তাবতিংস স্বর্গে যেতে পারতাম। এ বলে দেবপুত্র ভন্তেকে শ্রদ্ধা-ভক্তি ও বন্দনা জ্ঞাপন করে স্বর্গে ফিরে গেলেন ।

দল্হতোনামে একজন মেয়ের ত্রিশরণ ধারণে বৌদ্ধধর্মের পুণরুথান
       অতীতে মায়ানমার দেশটি  হংসবতী রাজ্য নামে পরিচিত ছিল। পুরো রাজ্যই ছিল মোন রাজার শাসনাধীন। সে সময়ে তিস্স নামক এক রাজা শাসন করতেন। সকলেই বৌদ্ধ ধর্ম পালন করতেন। রাজ পরিষদের মধ্যে মন্ত্রী পর্যায়ের কিছু লোক ব্রাহ্মণ বাদী ছিলেন। ব্রাহ্মণ বাদী মন্ত্রীরা রাজাকে বলতেন, মহারাজ বুদ্ধতো পরিনির্বাপিত হয়ে গেছেন। জীবিতহীন বুদ্ধ মূর্তিকে পূজা করে কোন লাভ নেই। তার চেয়ে আমাদের জীবিত মহাব্রহ্মাকে পূজা করলে পুণ্য হবে। ব্রাহ্মণ বাদী মন্ত্রীরা বার বার রাজাকে এ কথা বলাতে, রাজা চিন্তা করলেন, ঠিকই তো। একদিন রাজা বৌদ্ধ ধর্ম ত্যাগ করে ব্রাহ্মণ ধর্মে দীক্ষিত হন। যেদিন ব্রাহ্মণ ধর্ম গ্রহণ করলেন, সেদিন থেকে রাজ্য বাসীকে ঘোষণা করে দিলেন আজ থেকে বুদ্ধ মূর্তিগুলো অগ্নিতে, পানিতে,জঙ্গলে নিক্ষেপ কর। যে ব্যক্তিকে বুদ্ধের মূর্তি পূজা করতে দেখা যাবে, তাকে হস্তির পদতলে পিষ্ট করে মেরে ফেলা হবে এবং সকলেই  ব্রাহ্মণ ধর্ম পালন করবে। বৌদ্ধ দুই ধরণের-জন্মগত বৌদ্ধ,আচরণগত বৌদ্ধ। জন্মগত বৌদ্ধরা হচ্ছে, পূর্ব পূরুষরা যেভাবে ধর্ম পালন করেছে তারাও সেভাবে বৌদ্ধ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু প্রকৃত অর্থে তারা বুদ্ধের মূল শিক্ষা সম্পর্কে কিছুই জানে না, জানার চেষ্টাও করে না। শুধুমাত্র সামাজিকতা বজায় রেখে চলে। আর আচরণগত বৌদ্ধরা, বুদ্ধের প্রকৃত শিক্ষাকে অনুধাবন করেন। তা আচরণের মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রকৃত বৌদ্ধ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। এ দুই প্রকার বৌদ্ধের মধ্যে তিস্স নামক রাজা ছিলেন একজন জন্মগত বৌদ্ধ। প্রকৃত বৌদ্ধ ধর্মের মূল তত্ত্ব জানতেননা বিধায়  নিজ ধর্ম ত্যাগ করে ব্রাহ্মণ বা সনাতন ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। আমরাও যদি জন্মগত বৌদ্ধ হয়ে থাকি,তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ কি হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। তাই প্রত্যেককেই আচরণে বৌদ্ধ হবার চেষ্টা করতে হবে। ঐ রাজার কারণে রাজ্য বাসীর সকলকেই নির্বাণ প্রদায়ী ধর্ম ত্যাগ করতে হয়েছিল। সকলেই মৃত্যুর ভয়ে নিজ নিজ বাড়ীতে পূজাকৃত বুদ্ধ মূর্তি অগ্নিতে পোড়াল,পানিতে ভেসে দিল,কেউ জঙ্গলে ফেলে দিল। কিন্তু
দল্হতো নামে একজন যুবতী মেয়ে ত্রিশরণকে শ্রদ্ধাভরে মানত। তার মাতা-পিতা যখন বুদ্ধ মূর্তি ত্যাগ করতে চেয়েছিল,তখন মেয়েটি বলল মা ফেলে দেবেননা আমাকে দাও,আমি  পূজা করব। মাতা-পিতা মেয়েকে বলল,মা রাজা আদেশ করেছে যাদের বাড়ীতে বুদ্ধ মূর্তি রাখা হবে তাদেরকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হবে। মেয়ে বলল,মা,বুদ্ধ পুজা করে বা ত্রিশরণ ধারণ করে মৃত্যু হলেও কোন ক্ষতি নেই। কারণ বুদ্ধ পুজা করে বা ত্রিশরণ ধারণ করে কোন ব্যক্তি দুর্গতিতে গমন করেন না বরং সুগতি প্রাপ্ত হয়। মাতা-পিতা মেয়েকে বলল,ঠিক আছে নাও তবে রাজা যদি জানতে পারেন,তাহলে আমরা জানি না। তোমার দোষে তুমি দোষী হবে। দল্হতোমেয়েটি বুদ্ধ মূর্তিটি শ্রদ্ধাভরে নিয়ে, তার নিজের ঘরে বুদ্ধের আসন স্থাপন করে,পূজা করতে লাগল। আর একদিন সে দেখল নদীর মাঝখান দিয়ে মানুষের ফেলে দেওয়া বুদ্ধ মূর্তি ভেসে যাচ্ছিল। দল্হতোমেয়েটি ভেসে যাওয়া বুদ্ধ মূর্তি দেখার সাথে সাথে তা পূজা করার উদ্দেশ্যে কুড়িয়ে আনল। অন্যেরা মেয়েটিকে বুদ্ধ মূর্তি নিয়ে যেতে দেখে বলল, দল্হতোতুমি জান না,রাজা ঘোষণা করেছে,যার কাছে বুদ্ধ মূর্তি পাওয়া যাবে, তাকে হস্তির পদদলিতে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হবে। হ্যাঁ জানিতো। তবে এও জানি বুদ্ধকে পূজা করলে পাপ হয় না,বরং পুণ্য হয়। বুদ্ধ পূজা করে মৃত্যু হলে হোক,আমি পূজা করবই। বাড়ীতে আনয়ন করে,নিজের কামড়ায় আসনে স্থাপন করল। ইহা একে অপরের মুখোমুখি জানা জানি হয়ে, রাজার নিকট সংবাদ পৌঁছল যে,দল্হতোনামে একজন মেয়ে বুদ্ধ মূর্তি পূজা করে। রাজা শোনার সাথে সাথে আদেশ দিলেন,মেয়েটিকে ধরে আনা হোক।দল্হতোকে বন্দী অবস্থায় আনয়ন করা হল। তার চিত্তে কোন রকম ভয়  ছিলনা,মরলে ত্রিশরণ নিয়ে মরব, মনে মনে এরূপ অধিষ্ঠান করল। তাকে মৃত্যুদন্ড দেবার জন্য সব কিছু প্রস্তুত। ব্রাহ্মণ বাদী মন্ত্রীরা মনে মনে খুশী। রাজা,মন্ত্রী পরিষদ সকলে দেখতে লাগলেন। মেয়েটিকে মাটিতে শোয়ানো হল,হাতি প্রস্তুত রাখা হয়েছে মারার জন্য।দল্হতোনির্ভীক চিত্তে ছিল। কারণ তার কাছে ত্রিশরণ আছে। সে শ্রদ্ধা-ভক্তি সহকারে ত্রিশরণ স্মরণ করতে লাগল,বুদ্ধং সরণং গচ্ছামি,ধম্মং সরণং গচ্ছামি,সংঘং সরণং গচ্ছামি। মেয়েটির দিকে এগিয়ে আসতে হাতি কিছুতেই সক্ষম হল না। বরং পেছন দিকে পিছ পা দিয়ে চলে গেল। দ্বিতীয় বার,তৃতীয় বার চেষ্টা করল,কিছুতেই হত্যা করতে পারল না। মিথ্যাদৃষ্টি সম্পন্ন ব্রাহ্মণরা চিন্তা করলেন,এ মেয়েটিকে হত্যা করতে না পারলে,বৌদ্ধ ধর্ম পুণরায় উত্থান হতে পারে। সুতরাং মেয়েটিকে অবশ্যই হত্যা করতে হবে। ব্রাহ্মণরা বললেন,মহারাজ মেয়েটির কাছে নিশ্চয়ই প্রেতœী ভর করে আছে। এরূপ প্রেতœীকে  অগ্নি দিয়ে পুড়িয়ে ফেলতে হয়। রাজা আদেশ দিলেন, অগ্নি দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হোক। মেয়েটি পুণঃ পুণঃ ত্রিশরণকে স্মরণ করতে লাগল। অগ্নিতে যখন দগ্ধ করার চেষ্টা করা হল অগ্নি নিভে গেল মেয়েটির শরীরে কোন রকম অগ্নির উত্তাপ অনুভূত হল না এবং একটি লোমও পুড়লো না। কোন মতে পুড়ে ফেলতে পারল না। এবার আদেশ হলো মাটির গর্তে দেওয়া হোক। রাজা কিছুটা আশ্চর্য বোধ করলেন। গর্তে না দেবার পূর্বে রাজা মেয়েটিকে বললেন, দল্হতো হংসবতী রাজ্যে সকলেই ব্রাহ্মণ ধর্ম পালন করছে, অথচ তুমি একজন মাত্র বৌদ্ধ ধর্ম পালন করছ। শুনেছি তোমার বাড়ীতে পূজাকৃত আটটি বুদ্ধ মূর্তি রয়েছে। সে আটটি বুদ্ধ মূর্তি আমার রাজ প্রাসাদে নিমন্ত্রণ করে আনতে পারবে কি? যদি তুমি আনতে সক্ষম হও তাহলে আমি সহ রাজ্যবাসী সকলেই পুণরায় বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করব এবং তোমাকেও জীবন দান করব।দল্হতোবলল,ঠিক আছে রাজার কথা সত্যই থাকুক,স্থিতি থাকুক। তাহলে আমার হাতের বাঁধন খুলে দেওয়া হোক। তারপর সে শ্রদ্ধা-ভক্তি সহকারে বুদ্ধ গুণো অনন্ত,ধর্ম গুণো অনন্ত,সংঘ গুণো অনন্তকে অঞ্জলীবদ্ধ হয়ে বন্দনা করল এবং বলল, বুদ্ধ-ধর্ম-সংঘ অনন্ত গুণের অধিকারী বলে আমি জীবন উৎসর্গ করে ত্রিশরণ গ্রহণ করেছি,এ কথা সত্য। এ সত্য ক্রিয়ার ফলে আমার কামড়ায় পূজাকৃত আটটি বুদ্ধ,রাজার রাজ প্রাসাদে আগমন করার জন্য নিমন্ত্রণ করছি। সত্যি সত্যি সে আটটি বুদ্ধ মূর্তি আকাশ মার্গে উড়ে এসে রাজ প্রাসাদে আগমন করতে লাগল। রাজাসহ সকলেই আশ্চর্য হয়ে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিলেন।এতে রাজার অতীব শ্রদ্ধা উৎপন্ন হয়ে চোখের জল গড়িয়ে পরতে লাগল এবং করজোড় না করে আর থাকতে পারলেন না। সকলেই ভাবছেন জীবিতহীন বুদ্ধের এত গুণ থাকলে, জীবন্ত অবস্থায় কত গুণ থাকতে পারে। রাজা বললেন,দল্হতোআমি ভুল করেছি,আমাকে ক্ষমা কর। তারপর রাজাসহ রাজ্যবাসী সকলেই পুণরায় বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করলেন।দল্হতোকে øান করিয়ে, সুন্দর পোষাক পরিধান পূর্বক ভদ্রা দেবী নাম ধারণ করে রাণীর পদ মর্যাদায় অভিষিক্ত করলেন। রাজা ব্রাহ্মণদের বিচারের ভার ভদ্রা দেবীর উপর অর্পণ করলেন। ভদ্রা দেবীও কোন প্রকার দ্বেষ চিত্ত না রেখে মৈত্রী চিত্তে,ব্রাহ্মণদেরকে মৃত্যু দন্ড না দিয়ে রাজ্য থেকে বহিষ্কার করালেন।

ত্রিশরণ বিশ্বাসে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ
      মায়ানমার দেশে প্রায় সময় বিভিন্ন স্থানে ধর্ম শালায় হোক,মাঠের প্রান্তরে হোক,অলি-গলিতে হোক ধর্মসভা অনুষ্ঠিত হয়। একদিন এক এলাকায় গ্রন্থকার,ধর্মদেশক,কর্মস্থান গুরু উ জবন ছারাদকে ধর্মশ্রবণ করার জন্য নিমন্ত্রন করলেন। ভন্তে যথা সময়ে ধর্মদান করতে গেলেন। ধর্ম সভাতে একজন খ্রীস্টান পুলিশ গার্ড হিসেবে ডিউটি পালন করছিল। সে পুলিশ লোকটি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ছারাদর দেশনা শ্রবণ করার ইচ্ছা না থাকলে ও শ্রবণ করতে হচ্ছে। যেহেতু আপনা-আপনি শোনা যাচ্ছে। শ্রবণ করতে গিয়ে বুদ্ধ ধর্মের প্রতি কথা তার হৃদয়ে দাগ কেটেছে। কিন্ত কাউকে প্রকাশ করেনি। একদিন তিনি এক বৃক্ষের নীচে বিশ্রাম করতে গিয়ে  হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে পেলেন বৃক্ষের উপর থেকে এক খারাপ অপ দেবতা তাঁর গলা চেপে ধরছে।  খ্রীস্টান পুলিশটি  প্রাণ রক্ষার জন্য নিজ ধর্মের বাইবেল শাস্ত্র মনে মনে পাঠ করতে লাগলেন কিন্তু কিছুতেই অপ দেবতা ছাড়লনা। শেষ পর্যন্ত বৌদ্ধ ধর্মে শীল গ্রহণ করার সময় প্রথমে যা বলতে হয় অর্থাৎ বুদ্ধং সরণং গচ্ছামি,ধম্মং সরণং গচ্ছামি, সংঘং সরণং গচ্ছামি। এ ত্রিশরণকে তিনি মনে মনে স্মরণ করলে বিরাট চিৎকার করে অপদেবতা পালিয়ে যায়। তখন থেকে বুদ্ধ ধর্মের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা আরও বর্ধিত হয়। পূর্বে মনে মনে শ্রদ্ধা ছিল বটে কিন্তু এত বলবৎ হয়নি। বিপদ থেকে উদ্ধার হওয়ার পর যাঁর দেশনা শ্রবণ করে শ্রদ্ধা উৎপন্ন হয়েছিল,সে ভন্তেকে নিমন্ত্রণ জানিয়ে ত্রিশরণ গ্রহণ করার মাধ্যমে তিনি বৌদ্ধ ধর্মে প্রবেশ করেন। বৌদ্ধরা কোন প্রকার ভয়-ভীতি দেখিয়ে,ধন-দৌলত দেখিয়ে ধর্মান্তরিত করায় না। কর্মবাদী বৌদ্ধ ধর্মের কথা কারো হৃদয় স্পর্শ করলে তিনি স্বেচ্ছায় এ ধর্ম গ্রহণ করেন।

ত্রিশরণ সত্য ক্রিয়ায় বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ
      মায়ানমার দেশে মুসলিম এক মেয়ে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি খুবই শ্রদ্ধাশীল। কোথাও ধর্মদেশনা হলে তাঁর ধর্ম শ্রবণ করতে ইচ্ছা হয়,বুদ্ধ এবং জাদী দর্শন করলে বন্দনা করতে চায়,ভিক্ষু সংঘকে পিন্ডাচরণে দেখলে তার দান করার চিত্ত উৎপন্ন হয়
কি কারণে তার এরূপ চিত্ত উৎপন্ন হয়েছিল? বৌদ্ধ ধর্ম মতে,সে অতীত জন্মে নিশ্চয়ই একজন বৌদ্ধ ছিল। সে অতীত জন্মের সংস্কার বর্তমান জন্মে প্রতিফলিত হচ্ছে। তাই এ জন্মে জন্মগত বৌদ্ধ যারা তাদের অনাগত জন্মটা নিশ্চিত নয় যে, আমি আবার বৌদ্ধ পরিবারে জন্ম গ্রহণ করব। কারণ মার্গফল প্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত কেউ অনাগত জন্মের নিশ্চয়তা দিতে পারেন না। কমপক্ষে বিদর্শন জ্ঞানের প্রথম স্তর নামরূপ পরিচ্ছেদ জ্ঞান,প্রত্যয় পরিগ্রহ জ্ঞান লাভ করলেই,জন্ম-জন্মান্তর বৌদ্ধ হয়ে জন্ম গ্রহণ করা সম্ভব। সুতরাং জন্ম-জন্মান্তর অন্যধর্মে বা মিথ্যাদৃষ্টি পরিবারে জন্ম গ্রহণ করতে না চাইলে বিদর্শন ভাবনা করতে হবে। বিদর্শন ভাবনা করার পূর্বে চতুরার্য সত্য সম্পর্কে সদ্ধর্ম দেশনা শ্রবণ করতে হবে। নির্বাণ প্রদায়ী ধর্ম দেশনা করতে সক্ষম, সে রকম একজন সৎ গুরুর প্রয়োজন হবে। তাই সৎ গুরুর সন্ধান করে,তাঁর  সদ্ধর্ম দেশনা শ্রবণ করে, বিদর্শন ভাবনা চর্চা করতে হবে।  কিন্তু সে মেয়েটি মুসলিম জাতির ভয়ে ধর্মশ্রবণ করতে,বন্দনা করতে,দান দিতে পারে না। যেহেতু এদের ধর্মে বলা হয়েছে,অন্য ধর্মের প্রতি অনুরক্ত হওয়া যাবেনা। অন্যধর্মে ধর্মান্তরিত হলে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। আসলে প্রত্যেক ধর্মের বাক্ স্বাধীনতা থাকা প্রয়োজন। কারণ যে ধর্ম শুধুমাত্র ইহ জন্মে নয়,জন্ম-জন্মান্তর হিতের জন্য,মঙ্গলের জন্য,সুখের জন্য হবে, সে ধর্ম জ্ঞান-বুদ্ধি, বিচার-বিবেচনা করে গ্রহণ করা উচিত। যেমন আমরা দোকান থেকে একটি জিনিস ক্রয় করার সময় যাচাই বাছাই করে ভালটাই ক্রয় করি। ধর্মের বেলায় আরো বেশী চিন্তা ভাবনা বিচার বিবেচনা করে গ্রহণ করা উচিত। যেহেতু  অনন্ত সংসার চμে জন্ম-জন্মান্তর সুখের জন্য, হিতের জন্য, মঙ্গলের জন্য সত্যিকার ধর্মকে গ্রহণ করা উচিত। মেয়েটি চিন্তা করল,আমি যদি বৌদ্ধ স্বামী প্রাপ্ত হই,তাহলে দান,শীল,ভাবনা প্রভৃতি পুণ্য কর্ম সঞ্চয় করার সুযোগ পাবো। কিন্তু তার এই ইচ্ছার কথা পরিবারের কাউকে প্রকাশ করেনি। সে মনে মনে ত্রিশরণ গ্রহণ করে সত্য ক্রিয়া করল যে,এ ত্রিশরণের সত্য ক্রিয়ার ফলে আমি যেন বৌদ্ধ স্বামী প্রাপ্ত হই। মেয়েটির যখন বয়ঃসন্ধি হয় তখন বিয়ের প্রস্তাব আসে। প্রায় বিয়ের প্রস্তাব ঠিক-ঠাক হয় কিন্তু ভেঙ্গে যায়। এভাবে তিন চার বার বিয়ের প্রস্তাব এসেও বিয়ে হল না। মাতা-পিতা খুব চিন্তিত হয়ে, একজন নিজ জাতির ছেলের সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করাতে চেয়েছিল। কিন্তু সে ছেলেটিও এই মেয়েটিকে বিয়ে করতে রাজি নয়। শেষ পর্যন্ত একজন বৌদ্ধ পরিবারের ছেলের সাথে তার বিয়ে হয়। কেন বার বার বিয়ে ভঙ্গ হয়েছিল ? ত্রিশরণের সত্য ক্রিয়ার প্রভাবে বার বার বিয়ে ভঙ্গ হয়েছিল। আজকাল বৌদ্ধ মেয়েরা নির্বাণ প্রদায়ী ধর্ম ত্যাগ করে ধর্মান্তরিত হচ্ছে। এ কাহিনী থেকে একজন বৌদ্ধ হিসেবে এটাই শিক্ষা নেওয়া উচিত।

সরণগমন মহাথের ভন্তের জীবনী
       ৯১ কল্প পূর্বে বিপস্সী বুদ্ধের আয়ু ছিল একলক্ষ বৎসর। দীর্ঘায়ু হওয়াতে ত্রিশরণের পুণ্যের ফলও বহু ফলপ্রদ হয়েছিল। সে সময়ে বন্ধুমতী প্রদেশে একজন লোক অন্ধ মাতা-পিতাকে সেবা-যতœ সহকারে ভরণ-পোষণ করতেন। তার শ্রদ্ধা ছিল পরিপূর্ণ,প্রব্রজিত হবার ইচ্ছা থাকলেও কিন্তু হতে পারেননি।যেহেতু সংসারে সে একমাত্র সন্তান,সেহেতু অন্ধ মাতা-পিতাকে তাকেই সেবা করতে হবে। অন্যদিকে সে ছিল গরীব, দান করারও সামর্থ্য ছিল না। সে কারণে বিহারে গিয়ে,নিসভ মহাথের ভন্তের নিকট ত্রিশরণ গ্রহণ করেন। একবার ত্রিশরণ গ্রহণ করে একলক্ষ বৎসর ধরে ধারণ করেছিল। ত্রিশরণ গ্রহণ করার পুণ্যের ফলে,মৃত্যুর পর সুগতি প্রাপ্ত হয়। স্বর্গের দেবরাজ ইন্দ্র হয়ে আশি বার,চক্রবর্তী রাজা হয়ে পঁচাত্তর বার,অগণিত বার প্রদেশ রাজা ও একক রাজা হয়ে সুগতি লাভ করেছেন। জন্ম-জন্মান্তর উচ্চবংশে,শ্রেষ্ঠীকূলে জন্ম গ্রহণ করেছেন। কোন জন্মে তাঁকে অপায় গমন করতে হয়নি। অন্তিম জন্মে গৌতম বুদ্ধের সময়ে মানব জন্ম লাভ করেছেন।সাত বৎসর বয়সে অরহত্ব মার্গফল প্রাপ্ত হয়েছেন। ত্রিশরণ গ্রহণের ফলে তিনি যে অরহৎ হয়েছেন,তা চার প্রকার পরিষদের সামনে অবহিত করার জন্য গাথায় দেশনা করলেন- 
                       অপরিমেয়্যে ইতোকপ্পে, সরণং বুদ্ধস্স গচ্ছাহং।
                                দু¹তিং নাভিজানামি, সরণগমনে ফলং।
অনুবাদ- অপরিমেয় কল্পের মধ্যে বুদ্ধের শরণ গ্রহণ করার পর হতে,অপায় নামক দুর্গতি বলতে কি জানতে পারিনি এবং অপায়ে পতিত না হয়ে, মনুষ্য-জন্ম আর দেব-জন্ম লাভ করেছি। এটা ত্রিশরণ গ্রহণের সুফল।

                      সোহং সুত্বান সরণং, সরণং মে অনুস্সতি।
                                  একাসনে নিসীদিত্বা, অরহত্তম পাপুণি।
অনুবাদ- আমি সে ত্রিশরণের শব্দ শ্রবণ করার পর,নীরব-নিস্তব্ধ একটি আসনে উপবেশন করে, ত্রিশরণের গুণকে বার বার পর্যবেক্ষণে অরহত্ব মার্গফলে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছি। 
                      জাতিয়া সত্ত মে বস্সে, অরহত্তম পাপুণি,
                                   উপসম্পাদয়ি বুদ্ধো, গুণ পঞ্ঞায় চক্খুমা।
 অনুবাদ- আমি প্রতিসন্ধি গ্রহণ করার পর হতে সাত বৎসর বয়সে অরহত্ব মার্গফলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছি। তথাগত  সম্যকসম্বুদ্ধ দিব্যচক্ষু জ্ঞানে অবলোকন করে পরিপূর্ণভাবে জানতে পেরেছেন যে,আমার সে ত্রিশরণ গ্রহণের সুফলে এরুপ লাভ হয়েছে।

ত্রিশরণে মন্ত্রবিদ্যা নষ্ট হয়
      মায়ানমার দেশে একজন উপাসক যে কোন খাদ্য খাওয়ার পূর্বে,ত্রিশরণ গ্রহণ করে খেতেন। সেভাবে চর্চা করে আসতেছেন বহুদিন ধরে। আর একজন মেয়ে মন্ত্র বিদ্যায় ছিল খুব পারদর্শী। সে তার মন্ত্র বিদ্যা দিয়ে,মন্ত্র জপ করে করে মাছি করতে পারে। একসময় মেয়েটি  উপাসককে পরীক্ষা করার জন্য নিজ বাড়ীতে নিমন্ত্রণ করে এনে,খাবারের মাধ্যমে মন্ত্র-বিদ্যা প্রয়োগ করে। সে উপাসক প্রতিবারের মত খাবার খাওয়ার পূর্বে ত্রিশরণ ধারণ করে খেতে শুরু করলেন। যখন খাবার গ্রাস করে মুখে দিলেন,তখন মুখের ভেতরে এক ইঁদুর মরা। মেয়েটি এটা দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল। পূর্বে আমি এ মন্ত্রবিদ্যা প্রয়োগ করে মানুষ মেরে ফেলেছি। লোকটির নিকট নিজের ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে জিজ্ঞেস করল,আপনার নিকট যে মন্ত্র-বিদ্যা আছে,তা আমাকে শিখিয়ে দেবেন। লোকটি বললেন,আমার কোন মন্ত্র-বিদ্যা নেই। তবে আমার গুরুরা ছোট কাল থেকে ত্রিশরণ শিক্ষা দিয়েছেন। তাই আমি ছোট কাল থেকে ত্রিশরণ চর্চা করে আসছি। মেয়েটি ত্রিশরণের গুণের কথা শ্রবণ করে হতবাক হয়ে গেল। তখন থেকে সে মেয়েটি মন্ত্র-বিদ্যা ত্যাগ করে ত্রিশরণ গ্রহণে ধার্মিক উপাসিকা হয়।
এক ব্যবসায়ীর  ত্রিশরণ স্মরণ করার সুফল
      মায়ানমার দেশে সাতটি প্রদেশে বিভিন্ন জাতির মানুষ বসবাস করতো। প্রত্যেক প্রদেশের মধ্যে বিদ্রোহী গ্র
প ছিল। তন্মধ্যে তানেংসা স্টেটে বিদ্রোহী দমনের জন্য সরকার কর্তৃক বিভিন্ন স্থানে সেনা ক্যাম্প বসিয়ে পাহাড়া দিচ্ছিল। একদিন সেনাবাহিনী পাহাড়া দেবার সময় পানি পথে একটি স্টীমার যাচ্ছিল। স্টীমার যাচ্ছিল দেখে সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন স্টীমার দাঁড় করাতে বললেন। কিন্তু স্টীমার না থেমে চলতে লাগল। ক্যাপ্টেন চিন্তা করলেন, স্টীমারে নিশ্চয়ই বিদ্রোহী আছে। তা না হলে থামবে না কেন? সন্দেহ উৎপন্ন হওয়াতে সৈন্যদেরকে গুলি করার আদেশ দিলেন। বন্দুকের গুলি যখন ছুড়লেন তখন গুলি বের হয় না। উপরের দিকে গুলি ছুড়লে,গুলি বের হয়। পুণরায়  স্টীমারের দিকে গুলি ছুড়লে তা কোন মতেই বের হল না। ক্যাপ্টেন চিন্তা করতেছে,তাদের কাছে নিশ্চয়ই কোন রক্ষাকবচ মন্ত্র-বিদ্যা আছে। খুব তাড়াতাড়ি ক্যাপ্টেন স্পীড বোটে উঠলেন। স্টীমারের পেছনে পেছনে ধাওয়া করতে লাগলেন। ধাওয়া করতে করতে স্টীমারের নাগালের মধ্যে পৌঁছলেন এবং থামতে বললেন। ক্যাপ্টেন স্টীমারে উঠে দেখলেন,কোন বিদ্রোহী নেই,একজন ব্যবসায়ী লোক বসে আছেন। ক্যাপ্টেন লোকটাকে জিজ্ঞেস করলেন, কিছুক্ষণ পূর্বে আপনাদের  স্টীমারে বিদ্রোহী আছে মনে করে গুলি ছুড়েছিলাম কিন্তু গুলি বের হয় না,অথচ উপরের দিকে ছুড়লাম, গুলি বের হয়। আপনার নিকট কোন বন্দুকের গুলি বের না হবার রক্ষাকবচ মন্ত্র-বিদ্যা আছে নাকি? লোকটি বললেন,আছে তো। ক্যাপ্টেন বললেন, রক্ষা কবচ মন্ত্র থাকলে আমার নিকট বিক্রি করেন,আমি কিনব। আমরা সেনাবাহিনীর লোক, আপদে-বিপদে কাজে লাগবে। লোকটি বললেন,টাকা ছাড়া আপনাকে দেব। তাহলে দেন। তখন লোকটি বললেন, আমাদের প্রত্যেক বৌদ্ধদের কাছে এ রক্ষা কবচ আছে। কিন্তু আমরা তা জানিনা। আমরা শীল গ্রহণ করার সময় প্রথমে যে ত্রিশরণ গ্রহণ করি,সে ত্রিশরণই হচ্ছে রক্ষা কবচ। ত্রিশরণ হচ্ছে-বুদ্ধং সরণং গচ্ছামি। আমি বুদ্ধের শরণ বা আশ্রয় গ্রহণ করছি। ধম্মং সরণং গচ্ছামি। আমি ধর্মের শরণ বা আশ্রয় গ্রহণ করছি। সংঘং সরণং গচ্ছামি। আমি সংঘের শরণ বা আশ্রয় গ্রহণ করছি। এ তিন প্রকার আশ্রয়, জগতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ আশ্রয়। আপনারা যখন আমাদের দিকে বন্দুকের গুলি ছুড়ছিলেন,তখন আমি ত্রিশরণ শরণ করছিলাম। সে কারণেই গুলি বের হয় নাই। আমার গুরু ভন্তে আমাকে প্রায় সময় শিক্ষা দিতেন,যে কোন দূরবর্তী স্থানে যাবার মূহুর্তে  ত্রিশরণ শরণ করবে। তখন থেকে বহুদিন যাবৎ আমি ত্রিশরণ চর্চা করে আসছি এবং এখনো করি।  ক্যাপ্টেন এই ধার্মিক ব্যবসায়ী লোকটির কথা শ্রবণ করে,আশ্চর্য হয়ে গেলেন। ত্রিশরণের এমন গুণ আছে অথচ আমি একজন বৌদ্ধ হয়ে,ত্রিশরণ স্মরণের গুণের কথা পূর্বে জানতাম না। এখন জানতে পারলাম। তখন থেকে  সেনাবাহিনীর ঐ ক্যাপ্টেন ত্রিশরণের প্রতি শ্রদ্ধা সম্পন্ন হয়ে ত্রিশরণ স্মরণ চর্চা করতে লাগলেন।

ত্রিশরণ ধারণে সম্যক দেবতারা রক্ষা করে
      একজন ধার্মিক উপাসক প্রতিনিয়ত ত্রিশরণে পুথি ফেলে শমথ ভাবনা করতেন। একদিন এক চোর সে উপাসকের বাড়ীতে চুরি করতে গিয়ে দেখল যে,উপাসক ভাবনারত অবস্থায় আছেন। তাঁর পেছনে একজন তলোয়ারধারী দন্ডায়মান অবস্থায় পাহাড়া দিচ্ছিল। তলোয়ার ধারণকারী পাহাড়াদার চোরকে দেখে, চোরের পেছনে ধাওয়া করতে করতে বাড়ী পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিল। চোর বাড়ী পৌঁছার কিছুক্ষণের পর ভয়ে জ্বরে আক্রান্ত হয়। চোর নিজের ভুল বুঝতে পারল। একজন ধার্মিক উপাসকের বাড়ীতে চুরি করতে গিয়ে, তার জন্য আমাকে শাস্তি পেতে হচ্ছে। চোর সুস্থ হবার পর,সে ধার্মিক উপাসকের নিকট ক্ষমা প্রার্থনার জন্য গেল। চোর বলল,আমি একটি দোষ করেছি,আপনি আমাকে ক্ষমা করুণ। উপাসক কিছুই জানেন না, লোকটি কি জন্য ক্ষমা চাচ্ছে। চোর বলল,আমি আপনার বাড়ীতে একবার চুরি করতে এসেছিলাম বলে পূর্বেকার সব ঘটনাগুলো অবগত করল। তখন ধার্মিক উপাসক ত্রিশরণ গুণের কথা শুনালেন এবং চোর লোকটিকে ক্ষমা করলেন। সেদিন থেকে চোর লোকটি চুরি না করে,সৎভাবে জীবন যাপনের মাধ্যমে জীবিকা অর্জন করতে লাগল।

গরুর গাড়িতে একজন তুলা ব্যবসায়ীর কাহিনী
      শ্রীলংকা দ্বীপে রোহণ জনপদে একজন তুলা ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি একদিন গরুর গাড়িতে তুলা ভর্তি করে ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে দূরবর্তী একস্থানে রওনা দিলেন। যেতে যেতে পথি-মধ্যে গাড়ির চাকা কাঁদা মাটিতে আটকে যায়। গাড়িতে দুইটি গরু ছিল। একটি বৃদ্ধ ও আরেকটি যুবক। বৃদ্ধ গরুটির নাম ছিল
মহাদত্ত। গাড়িটি কাঁদা মাটি থেকে তুলে আনার শক্তি সামর্থ্য মহাদত্তের ছিল না। এদিকে ব্যবসায়ী লোকটি গাড়িটি তুলার জন্য মহাদত্তকে বেত্রাঘাত করতে লাগলেন। আরেকদিকে বাচনিকভাবে কর্কশ বাক্য দ্বারা বলতে লাগলেন,আজকে তুমি যদি তুলতে না পার,তাহলে আরো বেশী মালামাল বহন করতে হবে। এভাবে সাতবার বেত্রাঘাত এবং কর্কশ বাক্যের কারণে মহাদত্তযথাসাধ্য বল পূর্বক শক্তি প্রয়োগ করেছিল। তাই বুকের হৃৎপিন্ড ফেটে,মুখে রক্ত বমি করে,সেখানেই ঢলে পড়ে। ব্যবসায়ী লোকটি অসহায়ভাবে মহাদত্তকে সেখানে রেখে আরেকটি গরু নিয়ে গমন করে। ঐ পথে একজন কুমার নামক এক লোক আগমন করল। লোকটি মহাদত্তকে আহত অবস্থায় দেখে মালিক বিহীন মনে করে,ঢোল তৈরীর জন্য চামড়া কেটে নিয়ে গেল। দ্বিতীয় আরেক লোক আগমন করল। সে লোকটিও বেলা তৈরীর জন্য øায়ু কেটে নিয়ে গেল। তৃতীয় জন শিকারী আগমন করল। সে লোকটিও কোনরূপ দয়া-মমতা না রেখে মাংস কেটে কুকুরকে খাওয়াল। অন্যদিকে নিজ শরীরে উৎপন্ন হওয়া কৃমিগুলো কামড় দিচ্ছে। এভাবে অসহ্য দুঃখ-যন্ত্রনা নীরবে সহ্য করতে হয়েছিল। এরকম যদি কারো হয় তাহলে শরীরের মধ্যে কেমন দুঃখ-যন্ত্রনা অনুভূতি হবে উপলব্ধি করে দেখুন। ব্যবসায়ী লোকটি না হয় বিবেকহীন দয়াহীনভাবে অমানুষের মত ত্যাগ করে চলে গেল। আর বাকী তিনজন ব্যক্তিরও বিন্দুমাত্র মৈত্রী ভালবাসা উৎপন্ন হয়নি। পৃথিবীতে এরকম পাষান হৃদয়ের করুণাহীন মানুষও রয়েছে। সে সময়ে চূল পিন্ডপাতিক তিস্সমহাথের ভন্তে পাঁচশত জন ভিক্ষু সংঘ সহ সে রাস্তা দিয়ে গমন করছিলেন। মহাথের ভন্তে মহাদত্তকে দেখা মাত্রই তাঁর অন্তরে মৈত্রী করূণা জাগ্রত হল  এবং নিজ পাত্র দিয়ে পানি আনয়ন করে,ইচ্ছামত পানি পান করালেন। তারপর সতিপট্ঠানসূত্র দেশনা শ্রবণ করিয়ে ত্রিশরণে প্রতিষ্ঠিত করার শেষ দিকে মহাদত্ত মারা যায়। মৃত্যুর সাথে সাথে তাবতিংস স্বর্গে তিনশত যোজন স্বর্ণময় বিমানসহ এক হাজার দেবী লাভ করে। মহাদত্ত দেবপুত্র নামে তার পরিচিত হয় স্বর্গলোকে। দেবপুত্র দিব্যচক্ষু জ্ঞান দিয়ে দর্শন করলেন,আমি কি পুণ্যের প্রভাবে স্বর্গে উৎপন্ন হয়েছি? তিনি দেখলেন,চূল পিন্ডপাতিক তিস্সমহাথের ভন্তের মৈত্রী-করুণায়। তাঁর কৃতজ্ঞতার কথা স্মরণ করে মধ্য রাত্রিতে ভন্তের নিকট এক হাজার দেবী সহ আগমন করলেন। ভন্তেকে করজোড়ে বন্দনা জ্ঞাপন করে,এক পাশে স্থিতি অবস্থায় রইলেন। ভন্তে না জানার ভাণ করে জিজ্ঞেস করলেন,হে দেবপুত্র! তোমার চতুর্দিকে অতি সুন্দর বর্ণ  ছড়াচ্ছে এবং দেবীসহ তুমি পরিপূর্ণ। তুমি কোন দেবপুত্র?মহাদত্ত দেবপুত্রতার পূর্বের জীবনী শোনালেন। এরপর আমি যদি পঞ্চশীল নিতে পারতাম তাহলে যাম স্বর্গে যেতে পারতাম। পূর্বে তির্যক প্রাণী কূলে আমার নাম মহাদত্ত ছিল বিধায়,বর্তমানে আমাকে দেবরাজ ইন্দ্র সহ সকল দেবতারা  মহাদত্ত দেবপুত্রনামে ডাকে। ভন্তে আমি পূর্বের জীবনে তির্যক প্রাণী হয়ে অতি কষ্টে ছিলাম। ভন্তে তির্যক প্রাণী হয়েও আমি আপনার কল্যাণেসতিপট্ঠান সূত্রএবং ত্রিশরণ গ্রহণ করে স্বর্গ লাভ করেছি। আর পৃথিবীতে যারা মানুষ হয়ে বুদ্ধ শাসন লাভ করেছেন তারা এ ধরনের কত মহাপুণ্য সঞ্চয় করার সৌভাগ্য প্রাপ্ত হয়েছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ভন্তে অনুকম্পাবশত আমাদেরকে ত্রিশরণ সহ শীল প্রদান করে, সতিপট্ঠান সূত্রদেশনা করূণ। যেন ধর্ম নামক জাহাজে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে নির্বাণ রাজ্যে পৌঁছতে সক্ষম হই। মহাথের ভন্তে ত্রিশরণ সহ পঞ্চশীল প্রদান করে,সতিপট্ঠান সূত্রদেশনা করলেন।সতিপট্ঠান সূত্রদেশনার শেষান্তেমহাদত্ত দেবপুত্র একহাজার দেবীসহ স্রোতাপত্তি মার্গফলে প্রতিষ্ঠিত হন। তারপর মহাথের ভন্তের প্রতি কৃতাঞ্জলি জানিয়ে, হংসরাজ পক্ষীর ন্যায় আকাশ মার্গে তাবতিংস স্বর্গে প্রত্যাগমন করলেন।

বুদ্ধানুস্মৃতি ভাবনার মাধ্যমে অরহত্ব মার্গ ফল লাভ
 এক সময় শ্রীলঙ্কাতে
ফুস্সদেব নামে একজন মহাথের ভিক্ষু প্রতিনিয়ত শ্রদ্ধার সহিত বুদ্ধানুস্মৃতি ভাবনা করতেন। উনি এমন শ্রদ্ধার সহিত বুদ্ধানুস্মৃতি ভাবনা করতেন যে,চারি ঈর্যাপথে ভাবনায় রত থাকতেন। বিশেষ করে বুদ্ধ ধাতু জাদীতে যখন ঝাড় দিতেন, তখন বুদ্ধানুস্মৃতি ভাবনা করতে তাঁর ভাল লাগত। কারণ ঝাড় দেওয়া শেষ হওয়ার পর পুনরায় যখন ফিরে তাকাতেন তখন জাদীতে ময়লাহীন পরিস্কার -পরিচ্ছন্নতা দেখে চিত্তে অন্যরকম এক আনন্দ অনুভূতিতে শরীরের লোম খাড়া হয়ে যেত এবং ভগবান বুদ্ধের ক্লেশ নামক সমস্ত ময়লা ধ্বংস প্রাপ্ত হয়ে পরিশুদ্ধ চিত্তে প্রসন্নতা লাভ করতেন।
 অরহং-সমস্ত কামনা বাসনা সহ দেড় হাজার ক্লেশসমুহ নির্মূলকারী ময়লা আবর্জনামুক্ত নির্মল শ্রেষ্ঠ। অরহং- লোভ-দ্বেষ-মোহ প্রভৃতি বৈরী সমূহকে নিধনকারী। এভাবে
ফুস্সদেব ভন্তে প্রতিনিয়ত জাদীতে আগমন করেন। ঝাড় দেওয়ার মূহুর্তে মার দেবতা তিন তিনবার এসে অন্তরায় সৃষ্টি করেছিলেন। প্রথম দিনে বানরের রূপ ধারণ করে জাদী প্রাঙ্গনে শুকনো পায়খানা নিক্ষেপ করেন। দ্বিতীয় দিনে বৃদ্ধ গরুর রূপ ধারণ করে জাদী প্রাঙ্গনে গরুর পায়খানা ত্যাগ করেন। তৃতীয় দিনে বিশ্রী মানুষের রূপ ধারন করে অন্তরায় সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। এ বিশ্রী রূপ দেখে ফুস্সদেব ভন্তে বুঝতে পারলেন, এ গ্রামে এ ধরনের বিশ্রী রূপের কোন  মানুষ নেই। উনি বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি মারদেবতা নাকি? মার দেবতা বললেন, হ্যাঁ ভান্তে আমি মার দেবতা। ভান্তে বললেন, তাহলে আমি আপনাকে একটি অনুরোধ করি। আপনি তো বুদ্ধের সময়ে ছিলেন,ভগবান বুদ্ধকে দেখেছেন। তাহলে আপনি আমাকে বুদ্ধের রূপ ধারণ করে দেখাতে পারবেন কি? মার দেবতা বললেন,একেবারে হুবহু বুদ্ধের রূপ দেখাতে পারবো না,তবে কাছাকাছি দেখাতে পারবো। ভন্তে বললেন,কাছাকাছি দেখাতে পারলেও আমি সন্তুষ্ট হবো। মার দেবতা ঋদ্ধি বলে ভগবান বুদ্ধের রূপ যখন ধারন করলেন,তখন ফুস্সদেব ভন্তে, ভগবান বুদ্ধের রূপ দর্শন করে অতীব শ্রদ্ধা ও ভক্তিতে চিত্তে গভীর প্রশান্তি প্রীতি উৎপন্ন হয়েছিল। ক্লেশে পরিপূর্ণ মার দেবতা বুদ্ধের রূপ ধারণ করে ভন্তের চিত্তে এমন শ্রদ্ধা উৎপন্ন করে দিয়েছিল যে তাতে তিনি বন্দনা না করে থাকতে পারলেন না। তাহলে জীবিত বুদ্ধকে দর্শন করলে কত যে শ্রদ্ধা উৎপন্ন হতে পারে তা চিন্তার অতীত। ফুস্সদেবভন্তে, বুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি উৎপন্ন করে, বুদ্ধানুস্মৃতি ভাবনা করার ফলে চিত্তে সৌর্মনস্য প্রসন্নতা প্রীতি-সুখ উৎপন্ন হয়ে উপাচার সমাধি লাভ করেছিলেন। রূপ ও নামের উপর ত্রিলক্ষণ জ্ঞান দ্বারা বিদর্শন ভাবনা করে স্রোতাপত্তি মার্গফল,সকৃদাগামী মার্গফল,অনাগামী মার্গফল ও অরহত্ব মার্গফলে প্রতিষ্ঠিত হন।
 বুদ্ধানুস্মৃতি ভাবনা করার পুণ্যের ফলে প্রীতি লাভ করে, কায়িক ও মানসিক প্রশান্তি লাভ করে, সুখ লাভ করে, চিত্তে একাগ্রতা উৎপন্ন হয়ে উপাচার সমাধি লাভ হয়। ইহ জন্মে উপাচার সমাধি এবং মার্গফল প্রাপ্ত না হলেও পরবর্তী জন্মে  সহজে নির্বাণ ধর্ম দর্শন করতে সক্ষম হয়।
সুতরাং সকল নির্বাণকামী বৌদ্ধ উপাসক-উপাসিকাগণের বুদ্ধানুস্মৃতি ভাবনা করা উচিত। এ জীবনে মার্গফল প্রাপ্ত না হলেও বুদ্ধানুস্মৃতি ভাবনা করে নির্বাণের বীজ বপন করা সম্ভব। চতুর্রক্ষক কর্মস্থানের মধ্যে ও বুদ্ধানুস্মৃতি ভাবনা  উত্তম কর্মস্থান।
  ভাবনা না করেও শুধুমাত্র বুদ্ধের নয় প্রকার গুণকে শ্রদ্ধা-ভক্তি চিত্তে বন্দনা ও পূজা করার পুণ্যের ফলে  ১৭ প্রকার সুফল লাভ করে।
        (১) চৈত্য বা জাদীর মত অন্য ব্যক্তিরা তাঁকে বন্দনা জানিয়ে পূজা করে।
 (২) বীর্যবান হয়।
 (৩) মৃত্যুর পর সুগতি লাভ করে।
 (৪) অনাগত জন্মে বুদ্ধের দর্শন লাভ করে,সহজে চতুরার্য সত্য দর্শন করতে পারে।
 (৫) উত্তম আত্মীয়-স্বজন লাভ করে।
 (৬) অপরের কাছ থেকে শ্রদ্ধা-ভক্তি পূজা লাভ করে।
 (৭) পরিপূর্ণ শরীর লাভ করে।
 (৮) শরীরের বর্ণ সুন্দর হয়।
 (৯) শরীর থেকে এক জাতীয় সুগন্ধ বাহির হয়।
 (১০) মুখ থেকে সুগন্ধ বাহির হয়।
 (১১) শ্রেষ্ঠ প্রজ্ঞাবান হয়।
 (১২) গভীর প্রজ্ঞাবান হয়।
 (১৩) তীক্ষè প্রজ্ঞাবান হয়।
 (১৪) দ্রুত গতি সম্পন্ন প্রজ্ঞাবান হয়।
 (১৫) প্রসন্নময় হয়।
 (১৬) বিচিত্রময় হয়।
 (১৭) সুভাসিত ভাবে কথা বলতে পারে।


বৌদ্ধধর্ম বিশ্বাসে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ
 মায়ানমার দেশে মান্ডালে শহরে এক মুসলিম মেয়ে রোগে আক্রান্ত হয়ে আয়ুক্ষয়ে মৃত্যু বরণ করে। মৃত্যুর পর প্রেতলোকে জন্মগ্রহণ করে। তার মাতা-পিতা নিজস্ব ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মৌলবী নিমন্ত্রণ করে, বিভিন্ন দান-দক্ষিণা দিয়ে পুণ্য সঞ্চয় করলেন । সেই দিন মেয়েটি রাত্রিতে পিতার সামনে বিশ্রীরূপে দেখা দিল। পিতা খুবই ভয় পেয়েছিল। পরে এই কথা পরিবারের সকলকে জানাল। সে মুসলিমের একজন বার্মিস বন্ধু ছিল। তার বন্ধুকে ঘটনা গুলো সে বিস্তাারিতভাবে জানাল। বার্মিস উপাসক তার বন্ধুর কথা শুবন করে সব বুঝতে পারলেন। কারণ বৌদ্ধ ধর্মে এসব জন্ম-জন্মান্তর সম্পর্কে বর্ণনা করা আছে। তাই বার্মিস বন্ধু বুঝতে পারলেন,নিশ্চয়ই উনার মেয়ে প্রেত্মী হয়েছে। এ ধারণায় সে বার্মিস মুসলিম বন্ধুকে বললেন,বৌদ্ধ  ভিক্ষুসংঘ নিমন্ত্রণ করে, দান-দক্ষিণা দিয়ে উৎসর্গ করার পর পুণ্য রাশি প্রদান করলে উদ্ধার হবে। মুসলিম বন্ধু এ কথা শুবণে রাজি হয়ে গেল। তবে সে বলল আমি কিন্তু কিছুই জানি না,আপনাকে এ ব্যাপারে সাহায্য-সহযোগিতা করতে হবে। তারপর বার্মিস বন্ধু ভিক্ষু সংঘকে নিমন্ত্রণ করলেন। প্রয়োজনীয় দানীয় সামগ্রী কিনলেন। যথা সময়ে ভিক্ষু সংঘ বাড়িতে আগমন করেন। ছোয়াইং খাওয়ানোর পর শীল গ্রহণ করে দানীয় দ্রব্যাদি ভিক্ষু সংঘকে মেয়ের উদ্দেশ্যে দান করলেন। এতে যে পুণ্য সঞ্চয় করল সে পুণ্যরাশি মেয়ের উদ্দেশ্যে বিতরণ করল। সে দিন রাত্রিতে তার মেয়ে দেবীর পোশাক পরিধান করে পিতার সামনে দেখা ছিল। তার মেয়ে উদ্ধার  হয়ে স্বর্গে গমন করেছে প্রমাণ পেয়ে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি তার প্রগাঢ় শ্রদ্ধা-বিশ্বাস উৎপন্ন হল। তখন থেকে মুসলিম বন্ধুর পরিবার বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাস স্থাপন করে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করল।
 
   বৌদ্ধ ধর্মের সাথে অন্যান্য ধর্মের পুণ্যের পার্থক্য     
 মায়ানমারে কারেন প্রদেশে দুই বন্ধু ছিল। এক জন বন্ধু খুবই ধার্মিক ছিলেন। সে বিহার দান,ভিক্ষু-সংঘকে ছোয়াইং দান,রাস্তা সংস্কার করা ও বিভিন্ন প্রকার কুশল কর্মে নিয়োজিত থাকতো। আরেক বন্ধু অধার্মিক ছিল। কোন প্রকার পুণ্য কর্ম করত না। অথচ তার কাছে টাকাও ছিল। কিন্তু পুণ্য করার মত শ্রদ্ধা-চেতনা নাই। হঠাৎ এক সময় সে বৌদ্ধ ধর্ম ত্যাগ করে খ্রীস্টান ধর্ম গ্রহণ করে। এক দিন জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বেহুশ হয়ে, নরকের নিমিত্ত দর্শন করতে লাগল। সে দেখছে যে, বিশাল আকারের কালো কুকুরগুলো তাকে কামড়াতে ছুটে আসছে। তখন সে দৌঁড় দিতে লাগল। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে সে দেখতে পেল সুন্দর উদ্যানে একটি বাগান-বাড়ি। বাড়িতে ঢুকতে চাইলে রক্ষাকারী দেবতারা তাকে ঢুকতে দিল না। রক্ষাকারী দেবতারা বলল, তুমি কোন পুণ্য কর্ম কর নাই। সেজন্য তোমার স্বর্গে স্থান নেই। তোমার জন্য নরকের দরজা খোলা। স্বপ্ন হলেও বাস্তব কাহিনী। পৃথিবীতে এরকম অনেকেই আছেন যারা জীবন্ত অবস্থায় স্বর্গ এবং নরকের নিমিত্ত বাস্তবে দেখতে পান। সে লোকটি পুণরায় হুশ ফিরে পেয়ে সংবেগ প্রাপ্ত হয়ে তার বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে বিস্তারিত জানালো। এরপর পুণরায় সে বুদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে, বিভিন্ন পুণ্য কর্ম সম্পাদন করে জীবন ধারন করত। যে ধর্ম সত্ত্বগণকে মুক্তি দিতে পারে না, সেটা ধর্ম হতে পারেনা। আর যে ধর্ম সত্ত্বগণকে সংসার দুঃখ থেকে উদ্ধার করতে পারে, সে ধর্ম হলো সত্যিকার ধর্ম। যে ধর্মে প্রথমে কল্যাণ,মধ্যে কল্যাণ,অন্তে কল্যাণকর সে ধর্মকে প্রকৃত ধর্ম বলে অভিহিত করা হয়। সেই প্রকৃত ধর্ম হচ্ছে নির্বাণ প্রদায়ী বৌদ্ধ ধর্ম। সেই নির্বাণ প্রদায়ী ধর্ম হলো পরম শান্তি-পরম সুখের।
 
   একটি ছোট্ট কুটিরে বাঁশ দানের পুণ্য ফলে নরক থেকে উদ্ধার
 মায়ানমারের এক প্রদেশে জঙ্গলের পুরানো একটি জাদীতে একজন ভিক্ষু ধ্যান সাধনা করতেন। একদিন একজন শ্রদ্ধাবান উপাসক জাদী দর্শন করতে এসে দেখলেন, সে ভিক্ষু জাদীতে ধ্যানরত অবস্থায়। শ্রদ্ধাবান উপাসক ভন্তেকে দর্শন করার পর চিত্তে প্রগাঢ় শ্রদ্ধা উৎপন্ন হয়েছিল। যখন ধ্যান থেকে উঠলেন উপাসক ভন্তের নিকট গিয়ে জিজ্ঞেস করল,ভন্তে আপনি কোথায় থাকেন? ভন্তে বললেন,আমি জাদীর প্রাঙ্গনে থাকি। ভন্তে তাহলে আমি ছোট্ট একটি কুটির তৈরী করে দান করব। তখন সেই বাড়িতে গিয়ে সামর্থ্য অনুযায়ী বাঁশ-গাছ সংগ্রহ করলো। তার একজন মিথ্যাদৃষ্টি সম্পন্ন বন্ধু ছিল,সে দেবতা পূজারী। তাকে গিয়ে বলল,বন্ধু আমি একজন ভন্তের জন্য একটি ছোট্ট কুটির নির্মাণ করছি। তাই আমার কিছু বাঁশের প্রয়োজন। তুমি যদি দান কর তাহলে তোমার বহু পুণ্য সঞ্চয় হবে। মিথ্যাদৃষ্টি সম্পন্ন ঐ বন্ধরু বৌদ্ধ ধর্ম সম্বন্ধে কোন জ্ঞান ছিল না। দান দিলে কি পুণ্য হয়,শীল পালন করলে কি সুফল লাভ করে প্রভৃতি পুণ্যকর্ম সম্বন্ধে তার কোন ধারণা নেই। সে জন্য জিজ্ঞেস করছে,বাঁশ দিলে কি ফল পাবো। উপাসক বন্ধু বলল,বাঁশ দান করলে তোমার জমিতে ভাল ফসল ফলবে। উপাসক বন্ধুর কথা বিশ্বাস করে সে মাত্র চারটি বাঁশ দান করল। সে বাঁশগুলো সহ আরো বাঁশ দিয়ে কুটির নির্মাণ করে ভন্তেকে দান করলেন। দান করার কয়েক সপ্তাহ পর মিথ্যাদৃষ্টি সম্পন্ন বন্ধু একদিন কাজ করার সময় পাহাড় থেকে পড়ে আঘাত প্রাপ্ত হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। অজ্ঞানের পর সে দেখতে পেল,বিশাল আকারের শরীরধারী নরকপাল তাকে ধরে মাটির নীচে নরকের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ঐখানে মস্ত বড় একটি পাত্রে ফুটন্ত গরম পানিতে নরক বাসীকে সিদ্ধ করছে। তাকেও সে গরম পাত্রে ফেলে দেওয়া হল কিন্তু চারটি বাঁশ এসে আটকে দিল। এভাবে দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার ফেলতে চাইলেও কিছুতেই সক্ষম হলনা। তখন তারা যমরাজার নিকট এসে তাকে পাত্রে ফেলতে না পারার কথা ব্যক্ত করল। যমরাজ জিজ্ঞেস করলেন,তুমি মনুষ্যলোকে কি পুণ্য কর্ম করেছিলে? সে বলল,আমি ভন্তের জন্য কুটির নির্মাণে চারটি বাঁশ দান করেছিলাম। যম রাজ বললেন,এবার তুমি পুণরায় মনুষ্যলোকে গিয়ে পুণ্যকর্ম সম্পাদন কর। এভাবে অজ্ঞান অবস্থায় তিন দিন অতিবাহিত হবার পর, সে পুণরায় জ্ঞান ফিরে পেল। সকলেই তার মৃত্যু হয়েছে  মনে করে শ্মশানে নিয়ে গেল। শ্মশানে তাকে আগুনে দেওয়ার জন্য বহু মানুষ সমবেত হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ সে লোকটি মৃত্যু থেকে যখন জীবিত হল,তখন সরাসরি তাকে বিহারে নিয়ে যেতে বলল। সে সকলের সামনে বাস্তব জীবনের নরকের কাহিনী শোনাল। তখন থেকে সে গ্রামের লোকেরা সকলেই বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে।

একজন শ্রদ্ধাবান উপাসকের হৃদয়ে বুদ্ধ স্থাপন
  এক গ্রামে
ফুথিন নামে এক উপাসক ছিলেন। বুদ্ধমূর্তি দান করব বলে লটারী কাটলেন। লটারী কেনে ১ লক্ষ টাকা ভাগ্যে জুটে গেল। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল সে বুদ্ধমূর্তি স্থাপন করবে। তাই সে পঞ্চাশ হাজার টাকা দামের একটি জায়গা কিনল। জায়গা কেনার পর একজন লোক এসে এই জায়গাটা আমার বলে দাবীদার হয়ে বিচার দিল। বিচারের কাজে বাকী ৫০ হাজার টাকাও খরচ হয়ে গেল। শুধু তাই নয় নিজের থেকেও ৫০ হাজার টাকা খরচ হল। ফুথিন উপাসকের মন খারাপ হয়ে গেল। বুদ্ধ স্থাপন করবে বলে লটারী ভাগ্যে জুটল কিন্তু এখন বিপরীত হয়ে গেল। আমি যেটা চিন্তা করেছিলাম আশা পূরণ হল না। অতি মনের দুঃখে বিহারে গেলেন। বিহারে এসে  তাঁর নিজের মনের দুঃখের কথাগুলো ভন্তেকে বললেন। ভন্তে আমি বুদ্ধ স্থাপন করব বলে উদ্দেশ্য করে লটারী কিনেছিলাম। সে লটারী ভাগ্যেও জুটেছিল। বুদ্ধ স্থাপন করব বলে কাজ শুরু করেছিলাম। সব এলোমেলো হয়ে গেল। আমি যেমন চিন্তা করেছিলাম সেই রকম না হয়ে বিপরীত হয়ে গেল। এখন মনের দুঃখে বুদ্ধ স্থাপন করার আগ্রহ একটুও নেই। উ-তিস্স ভন্তে বললেন, হে উপাসক তুমি কি জন্য বুদ্ধ স্থাপন করতে চাও? উপাসক বললেন, পুণ্য সঞ্চয়ের জন্য ভন্তে। তাহলে পুণ্য পেতে চাইলে একেবারে সহজ। সত্যিকার অর্থে তুমি যদি বুদ্ধ স্থাপন করতে চাও,তাহলে তোমার কোন টাকা বা মাটির প্রয়োজন হবে না। কিভাবে টাকা ও মাটি ছাড়া বুদ্ধ স্থাপন করবো? ভন্তে বললেন, উপাসক তোমার কাছে হৃদয় নামক মাটি আছে যা কিনতে হবে না। হৃদয় নামক মাটিতে শ্রদ্ধা-প্রজ্ঞা-স্মৃতি স্থাপন করে রাখ। কোন কঠিন ব্যাপার নয়। খুবই সহজ ব্যাপার। উপাসক তুমি নমো তস্স বলতে পারো নাকি? বলতে পারি ভন্তে, আমি ছোটকাল থেকে বলতে পারি। তাহলে উপাসক তুমি নমো তস্সবলে বুদ্ধের গুণকে স্মরণ করে মনের মধ্যে আলম্বন করতে পারলে বুদ্ধকে স্থাপন করা যায়। উপাসক তুমি ত্রিশরণ বলতে পার নাকি? পারি ভন্তে। এবার তুমি ত্রিশরণের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ভক্তির সাথে প্রজ্ঞা দিয়ে আলম্বনে স্মৃতি সহকারে ত্রিশরণকে মনের মধ্যে স্থাপন করতে পারলে বুদ্ধ স্থাপন করা হবে। তুমি বুদ্ধের ৯ টি গুণ বলতে পার নাকি? পারি ভন্তে। তুমি শ্রদ্ধার সহিত প্রজ্ঞা উৎপন্ন করে স্মৃতি দিয়ে বুদ্ধের নয়টি গুণ বা যে কোন একটি বুদ্ধের গুণকে আলম্বনে স্মৃতি ভাবনা করতে পারলে মনের মধ্যে বুদ্ধ স্থাপন করা হয়। মাটিতে বুদ্ধ স্থাপন করতে গেলে মাটি, সিমেন্ট, বালি, ইট, রড প্রভৃতি প্রয়োজন হয়। কিন্তু হৃদয়ের মধ্যে বুদ্ধ স্থাপন করলে কোন টাকা খরচ হয় না। সুতরাং প্রথমে আমাদের প্রত্যকের হৃদয়ে বুদ্ধ স্থাপন করার পর, বুদ্ধ মূর্তি,বিহার প্রভৃতি পুণ্য সঞ্চয় করতে হবে। তার পূর্বে চাই শ্রদ্ধা সম্পত্তি। শ্রদ্ধা সম্পত্তি দিয়ে প্রজ্ঞা উৎপন্ন করে, স্মৃতি নামক রশি দিয়ে বুদ্ধানুস্মৃতি ভাবনা করলে, মনের মধ্যে বুদ্ধ স্থাপন করা হয়। প্রতি সেকেন্ডে, প্রতি মিনিটে, প্রতি ঘন্টায়, সারাদিন যখন স্মৃতি জাগ্রত হবে তখনি বুদ্ধ স্থাপন করা যায়। মাটিতে স্থাপন করতে গেলে দিন-মাস-বৎসর বহু সময়ের প্রয়োজন হয়। ভন্তে ঐ উপাসককে ধর্ম উপদেশ দিয়ে তাঁর মনে সুখ-শান্তি আনয়ন করালেন। উপাসক বললেন-ভন্তে,এভাবে হৃদয়ের মধ্যে বুদ্ধ স্থাপন করা যায় পূর্বে যদি জানতে পারতাম, তাহলে মনের দুঃখ পেতে হতো না। এখন আমি জেনে গেছি টাকা ও মাটি ছাড়া বুদ্ধ স্থাপনের পন্থা। আজ থেকে এখনি হৃদয়ে বুদ্ধ স্থাপন করব। ভন্তে,আপনি আমাকে ভব সংসারে সুখের পথ দেখিয়ে দিলেন তাই আপনার নিকট আমি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি বলে বন্দনা করে চলে গেলেন। উপাসক এবার থেকে সদা-সর্বদা স্মৃতি জাগ্রত করে হৃদয়ে বুদ্ধের গুণ স্মরণ করে বুদ্ধ স্থাপন চর্চা করতে লাগলেন। এভাবে চর্চা করাতে নমো-তস্স ত্রিশরণ বুদ্ধের-গুণ সুন্দরভাবে আলম্বন করতে শিখলেন এবং মৈত্রী ভাবনাও করতে পারেন। সেজন্য এখন আর তার মনে কোন দুঃখ নেই, মুখমন্ডলও উজ্জল প্রসন্নময় দেখা যায়। কাজে-কর্মে,ব্যবসা-বাণিজ্যেও সফল হয়েছে। লোকেরা তাঁকে এখন সম্মান করে। অবশেষে মনে বুদ্ধ স্থাপন করার পুণ্যের ফলে, ঐ জায়গার মালিক লোকটি ক্ষমা প্রার্থনা চাইতে এসেছিল। দাদা আপনি বুদ্ধ স্থাপন করবেন বলে জানতে পারলে, আমি এমনিতে মাটি দিতাম। আপনাকে পূর্বে আমি বুঝতে পারিনি বিধায় এরূপ হয়েছে। এখন আপনাকে আমি জায়গার মাটি ফেরত দিতে চাই। এতে আমি যদি কোন ভুল করে থাকি আমাকে ক্ষমা করবেন। জগতে শক্তির মধ্যে এক মাত্র ধর্মের শক্তি উত্তম। তখন উপাসক বললেন, আমার এখন মাটির প্রয়োজন নাই। ভাই আমি বুদ্ধ স্থাপন করেছি। দাদা আপনি কোথায় বুদ্ধ স্থাপন করেছেন? আমি হৃদয়ে বুদ্ধ স্থাপন করেছি। আমার হৃদয়ে এখন বুদ্ধ আছে, ধর্ম আছে, সংঘ আছে এবং মৈত্রীও সাথে আছে। তার কথা শুনে লোকটি চিন্তা করল,পূর্বে ফুথিন ঝগড়া করেছে। এখনকার ফুথিন আর পূর্বের ফুথিনের সাথে মিল নেই। এখন  ফুথিন রতœ হয়েছে। আবারো বলল, আপনার প্রতি আমার কোন ভুল-ত্রটি হয়ে থাকলে মৈত্রী গুণে ক্ষমা করবেন। এতে প্রমাণ হয় ত্রিরতেœর গুণে শত্র পর্যন্ত মিত্র পরায়ণ হয়। সকল প্রকার রোগ-ভয়-ব্যাধি-অন্তরায়মুক্ত হয়ে কায়িক ও মানসিকভাবে প্রশান্তি লাভ করে। ইহ জীবনে ও পারলৌকিক জীবনে নির্বাণ সুখ লাভ করতে সক্ষম হয়।



বৌদ্ধ ধর্মের সার
 বৌদ্ধ ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা, প্রকৃত ধর্ম রয়েছে ত্রিপিটক শাস্ত্রে। এই ত্রিপিটককে যদি সংক্ষিপ্ত করা হয় তাহলে ৩৭ প্রকার বোধিপক্ষীয় ধর্ম পাওয়া যায়। সে ৩৭ প্রকার বোধিপক্ষীয় ধর্ম হচ্ছে ৪ প্রকার স্মৃতিপ্রস্থান, ৪ প্রকার সম্প্রপ্রধান, ৪ প্রকার ঋদ্ধিপাদ, ৫ প্রকার ইন্দ্রিয়, ৫ প্রকার বল,৭ প্রকার বোধ্যঙ্গ, ৮ প্রকার আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ, সংক্ষিপ্তাকারে ইহাই বোধিপক্ষীয় ধর্ম।


৪ প্রকার স্মৃতিপ্রস্থান
 কায়ের স্মৃতিপ্রস্থান, বেদনার স্মৃতিপ্রস্থান, চিত্তের স্মৃতিপ্রস্থান ও ধর্মের স্মৃতিপ্রস্থান।
৪ প্রকার সম্প্রপ্রধান
 উৎপন্ন হওয়া অকুশলকে প্রহীন করার চেষ্টা করা, উৎপন্ন হয় নাই অকুশলকে উৎপন্ন না হয় মত চেষ্টা করা, উৎপন্ন হয় নাই কুশলকে উৎপন্ন হয় মত চেষ্টা করা,উৎপন্ন হওয়া কুশলকে বর্ধনের চেষ্টা করা।
৪ প্রকার ঋদ্ধিপাদ
 ইচ্ছা বা কামনা আধ্যাত্মিক শক্তির ভিত্তি,বীর্য বা সাহস আধ্যাত্মিক শক্তির ভিত্তি, চিত্ত আধ্যাত্মিক শক্তির ভিত্তি,প্রজ্ঞা আধ্যাত্মিক শক্তির ভিত্তি।
৫ প্রকার ইন্দ্রিয় বা সংবরণ
 শ্রদ্ধা-ইন্দ্রিয়, বীর্য-ইন্দ্রিয়, স্মৃতি-ইন্দ্রিয়, সমাধি-ইন্দ্রিয় ও প্রজ্ঞা-ইন্দ্রিয়।
৫ প্রকার বল বা শক্তি
 শ্রদ্ধা-বল, বীর্য-বল, স্মৃতি-বল, সমাধি-বল, প্রজ্ঞা-বল।
৭ প্রকার বোধ্যঙ্গ (জ্ঞান বা পন্ডিত্যের অন্যতম উপাদান) 
 স্মৃতি-সম্বোধ্যঙ্গ,ধর্মবিচার-সম্বোধ্যঙ্গ,বীর্য-সম্বোধ্যঙ্গ,প্রীতি-সম্বোধ্যঙ্গ,সমাধি-সম্বোধ্যঙ্গও উপেক্ষা-সম্বোধ্যঙ্গ।

৮ প্রকার মার্গ
 সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সংকল্প, সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম, সম্যক জীবিকা, সম্যক ব্যায়াম, সম্যক স্মৃতি, সম্যক সমাধি। প্রথমে শীলের অংশ হচ্ছে সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম, সম্যক জীবিকা। ৪ প্রকার স্মৃতি প্রস্থান ভাবনা করলে সম্যক স্মৃতি পরিপূর্ণ হয়। ৪ প্রকার সম্প্রপ্রধান ভাবনা করলে সম্যক ব্যায়াম পরিপূর্ণ হয়। সম্যক স্মৃতি ও সম্যক ব্যায়াম পরিপূর্ণ হলে সম্যক সমাধি লাভ হয়। সম্যক সমাধি লাভ হলে সম্যক দৃষ্টি ও সম্যক সঙ্কল্প  লাভ হয়। চতুরার্য সত্যকে দর্শন করা সম্যক দৃষ্টি। এ সম্যক দৃষ্টি পরিপূর্ণ হলে নৈষ্কর্ম সংকল্প, মৈত্রী সংকল্প ও করুণা সংকল্প পরিপূর্ণতা লাভ করে। সম্যক দৃষ্টি ও সম্যক সঙ্কল্প হচ্ছে প্রজ্ঞা বা মার্গজ্ঞানে অন্তর্গত। চতুরার্য সত্য দর্শন করলেই ৩৭ প্রকার বোধিপক্ষীয় ধর্ম পরিপূর্ণ হয়। এই ৩৭ প্রকার বোধিপক্ষীয় ধর্মকে সংক্ষিপ্তাকারে আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ বলা হয়। আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গকে সংক্ষিপ্ত করলে ত্রিশিক্ষা পাওয়া যায়। সে ত্রিশিক্ষা হচ্ছে অধিশীল-অধিচিত্ত-অধিপঞ্ঞ। অধিশীল হল-পঞ্চশীল, অষ্টশীল, শ্রামণের দশশীল, ভিক্ষুদের প্রাতিমোক্ষ শীল। এ অধিশীল পরিপূর্ণ হলে অধিচিত্ত লাভ করা যায়। অধিচিত্ত বলতে উপাচর-সমাধি, অর্পণা-সমাধি বুঝায়। অধিচিত্ত পরিপূর্ণতা হলে অধিপঞ্ঞ লাভ করা যায়। অধিপঞ্ঞ অর্থাৎ ত্রিলক্ষণ জ্ঞান দ্বারা ১৬ প্রকার বিদর্শন জ্ঞান লাভ করে মার্গজ্ঞান ফলজ্ঞান নির্বাণ ধর্মকে দর্শন করলেই অধিপঞ্ঞ পরিপূর্ণ হয়। এক কথায় শীল-সমাধি-প্রজ্ঞা হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্মের মূল শিক্ষা। প্রজ্ঞা মানে চতুরার্য সত্য, লোকত্তর ধর্ম, পরমার্থ ধর্ম, নির্বাণ ধর্ম সবগুলিকে একত্রে সদ্ধর্ম নামে অভিহিত করা হয়।

সমাপ্ত।
বুদ্ধ সাসনং চিরং তিট্ঠতু।